মৃত্যুদণ্ডের শিকার নিরপরাধীরা
৪ জুন ২০১৪ওকলাহোমায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক ব্যক্তিকে বিষাক্ত ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর তা ঠিকমত কাজে না লাগায় অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগে অবশেষে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি৷ আর এ জন্যই মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি আবার বিশ্বব্যাপী আলোচনায় উঠে আছে৷
অ্যামেরিকার রাজ্যগুলির মধ্যে টেক্সাসেই সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়৷ সব মিলিয়ে ১২৭০টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে সেখানে৷ এখনও কারা-প্রকোষ্ঠে ২৮০ জনেরও বেশি মানুষকে মৃত্যুর দিন গুণতে হচ্ছে৷ তবে অ্যামেরিকায় অনেকেই মনে করেন যে, যারা বাচ্চা বা পরিবারকে হত্যা করে, তাদের জন্য মৃত্যুদণ্ডই উচিত সাজা৷
হঠাৎ স্থগিত করা হয় মৃত্যুদণ্ড
রবার্ট ক্যামবেল হলেন এমনই একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি৷ একদিন সন্ধ্যা ছয়টায় তাঁর দণ্ড কার্যকর করার কথা ছিল৷ ক্যামবেল একজন আফ্রো-অ্যামেরিকান৷ পরিবার পরিজন কারাগারের কাছে অপেক্ষা করছিলেন৷ এমন সময় টেক্সাসের অপরাধ বিচার বিভাগের এক কর্মী জানান, এই দণ্ড হঠাৎ করেই স্থগিত করা হয়েছে৷ একটি ফেডারেল আদালত ক্যামবেলের আইনজীবীর দণ্ড পিছিয়ে দেওয়ার আবেদন শেষ মুহূর্তে মঞ্জুর করেন৷ এটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়৷ বলেন বিচার বিভাগের এক মুখপাত্র৷
বিনাদোষে হারিয়ে যায় ১৮টি বছর
আরেক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি অ্যানটোনি গ্রেভস বন্দি ছিলেন হান্টসভিলের কারাগারে৷ তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দিন দু'বার ধার্য করার পর দু'বারই পিছিয়ে দেওয়া হয়৷ অবশেষে ১৮ বছর বন্দি থাকার পর মুক্ত হন তিনি৷ তাঁর ঘটনাটা নতুন করে তদন্ত করা হয়৷ নির্দোষ প্রমাণিত হন তিনি৷ গ্রেভস হলেন ১৩৮ নম্বর আসামি, যাকে ভুলবশত মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়ার পর মুক্তি দেওয়া হয়৷
১৮ বছরেরও বেশি সময় কারাবন্দি, তাও আবার বেশিরভাগ সময় জানালাহীন একক সেলে৷ সামনে মৃত্যুর ছবি৷ নির্দোষ হয়েও এ এক চরম শাস্তি৷ কিভাবে তিনি তা সহ্য করেছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন তিনি, খুব সহজ সরল ছিলেন তখন৷ বিশ্বাস ছিল একদিন ন্যায়বিচার পাবেন৷ এই ধরনের সারল্য ছাড়া মৃত্যুর সেলে টিকে থাকা যেত না৷
প্রথমদিকে অবিশ্বাস্য মনে হতো৷ পুলিশ, সরকারি প্রসিকিউটর, বিচারক সবাই কীভাবে নেতিবাচক বদ্ধমূল ধারণাটা পোষণ করলেন? অ্যান্টোনির কথায়, ‘‘আমি শতভাগ সহযোগিতা করেছি৷''
একটি পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া তারপর তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, এক ভীষণ ব্যাপার৷ এই দোষারোপ সহ্য করার মতো নয়৷ ‘‘আমি নাকি মানুষ হত্যা করেছি৷ যাদের আমি চিনতামই না, যারা আমাকেও চিনতো না – এটা তো একেবারেই সম্ভব নয়'', বলেন অ্যান্টোনি৷
এ ছিল প্রচণ্ড আঘাত
গ্রেভসকে যখন হঠাৎ করে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়, তখন তা ছিল এক প্রচণ্ড আঘাত৷ কয়েক মাস অনিশ্চয়তায় থাকার পর যখন তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হলো, তখন শুধু তাঁর নিজের জীবনই ধ্বংস হয়নি৷ ‘‘গোটা পরিবারের জন্য ছিল তা এক নরক যন্ত্রণা৷ বিশেষ করে আমার মায়ের জন্য ছিল তা অসহনীয়'', জানান অ্যান্টোনি গ্রেভস৷
সাড়ে তিন বছর ধরে তিনি এখন স্বাধীন৷ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সময় লাগবে তাঁর৷ তিন ছেলে ছিল তখন বাচ্চা৷ আজ তাঁদের বয়স ২০-এর ঘরে, নিজেরাই বাচ্চার বাবা৷ দীর্ঘদিন একক সেলে থাকার পর মানুষের ভিড়ে অভ্যস্ত হতে হচ্ছে তাঁকে৷ ‘‘আমি বুঝতে পারি না কিভাবে আমি এ সব উতরে উঠেছি৷ এখন এক সুখি মানুষ আমি৷''
মুক্তির পর ক্ষতিপূরণের অর্থ দিয়ে হিউস্টোনে ‘অ্যান্টোনি গ্রেভস ফাউন্ডেশন' গড়ে তোলেন তিনি৷ ভুক্তভোগী পরিবারদের আইনি সহায়তা, ক্যাম্পেইন ইত্যাদি ব্যাপারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এই প্রতিষ্ঠানটি৷ যা থেকে গ্রেভস নিজে বঞ্চিত হয়েছিলেন৷
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেন ভুক্তভোগী
আজ তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য মানুষের আগ্রহের কমতি নেই৷ খ্যাতনামা আইনজীবী ও রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি এক মঞ্চে বসে বক্তব্য রাখেন তিনি৷ যেমন ভার্জিনিয়ার প্রাক্তন সরকারি প্রসিকিউটর মার্ক আর্লির পাশেও দেখা যায় তাঁকে৷ রিপাবলিকানার মার্ক আর্লি মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছেন৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমি সরকারি আইনজীবী হিসাবে ৩৬টি মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম৷ এক সময় আমি মৃত্যুদণ্ডের জোরালো সমর্থক ছিলাম, কিন্তু এখন আর তা নই৷''
তাঁর মতে এই দণ্ড প্রায়ই সুষ্ঠুভাবে কার্যকর করা হয় না৷ এই প্রসঙ্গে তিনি ওকলাহোমার ‘দুর্ঘটনা' এবং ভুল বিচারের প্রসঙ্গ টেনে আনেন৷
চার শতাংশই ভুল বিচারের শিকার
ন্যাশানাল অ্যাকাডেমি অফ সাইন্স-এর অনুমান মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের চার শতাংশই ভুল বিচারের শিকার৷ অর্থাৎ সঠিক প্রমাণের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে নির্দোষ ব্যক্তিদেরও মৃত্যুদণ্ড মাথা পেতে নিতে হয়৷ অ্যামেরিকায় বর্তমানে ৩,০০০-এরও বেশি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি তাঁদের সেলে আবদ্ধ রয়েছেন৷
অ্যান্টোনি গ্রেভস তাঁর ১৮ বছরের নিদারুণ অভিজ্ঞতার কথা মানুষের কাছে তুলে ধরেন এভাবে: ‘‘যে কারোর ক্ষেত্রে এটা ঘটতে পারে৷ যে কেউ এই অবস্থায় পড়তে পারেন৷''
এরপরও কিন্তু স্বদেশ অ্যামেরিকার ওপর আস্থা হারাননি তিনি, যে দেশটি ১৮ বছর ধরে তাঁর জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে৷ তাঁর মতে, সারা বিশ্ব অ্যামেরিকাকে উঁচু নজরে দেখে, তাই নৈতিক দিক দিয়ে দেশটির দায়বদ্ধতা কম নয়৷ ‘‘নিজের দেশের মানুষকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়া কোনো উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নয়৷ আমরা তো সবাই অ্যামেরিকান'', বলেন অ্যান্টোনি গ্রেভস৷