যারা ইউরোজোনের অন্তর্গত নয়, তারাই ব্যতিক্রম: বারোসো
১৩ নভেম্বর ২০১১দীর্ঘস্থায়ী সংকট
সব সংকটই আসে এবং কিছুকাল পর তা কেটে যায়৷ কিন্তু ইউরো এলাকার সংকটের চূড়ান্ত সমাধানসূত্র যে কী, তা আজও অজানা৷ গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল ও ইটালির মতো এক একটি দেশের সংকট কাটাতে বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চলছে৷ কমবেশি সাফল্য পেলেও সার্বিক সমাধানসূত্র দেখা যাচ্ছে না৷ আরও কতকাল ধরে জরুরি ভিত্তিতে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে যেতে হবে, এমন পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা ও ধৈর্যই বা কতদিন থাকবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে৷ বিশেষ করে ইটালির মতো এত বড় দেশের সংকট সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন ম্যার্কেল ও সার্কোজির মতো ইউরোপীয় নেতারা৷ দৈনন্দিন সংকটের উর্দ্ধে উঠে ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতির সার্বিক মূল্যায়ন করার সময় পাচ্ছেন না তাঁরা৷
দুর্বলদের বিতাড়নের চিন্তা
সমস্যার সমাধান করতে না পারলে সমস্যার মূল উপড়ে নেওয়ার কথাও বলছেন অনেকে৷ ভাবখানা এমন – মুমূর্ষু রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ হলে তার সেবা-যত্ন করে আর কী হবে! অর্থাৎ গ্রিস ও ইটালির মতো ধুঁকতে থাকা রোগীদের ইউরো এলাকা থেকে বের করে দিয়ে জার্মানি ও ফ্রান্স সহ শক্তিশালী কিছু দেশের সীমানার মধ্যে বেঁধে ফেলা যাক ইউরোজোন'কে৷ অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, লাগাতার সংকট কাটাতে এছাড়া আর কোনো বাস্তবসম্মত পথ খোলা নেই৷ জার্মানি ও ফ্রান্স অবশ্য এমন সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছে৷ এর বদলে জার্মানি বর্তমান সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে বেশ কিছু কাঠামোগত পদক্ষেপের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভিত্তি আরও মজবুত করতে চায়৷ ইইউ চুক্তির মধ্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে আরও কড়া নিয়ম ও শাস্তির বিধান অন্তর্গত করতে চায় ম্যার্কেল সরকার৷
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জোসে মানুয়েল বারোসো'ও ইউরো এলাকার বিভাজনের মতো নাটকীয় দাওয়াইয়ের কথা একেবারেই শুনতে প্রস্তুত নন৷ সম্প্রতি বার্লিনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাঠামোর মৌলিক কিছু বিষয় নিয়ে কথা বললেন৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিশেষ করে ইউরো এলাকার নির্দিষ্ট গতি থাকতে হবে৷ সেক্ষেত্রে এমন কোনো সদস্য দেশ আদর্শ হতে পারে না, যার নিজস্ব গতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অত্যন্ত দুর্বল৷ নিরাপত্তা অবশ্যই থাকতে হবে, বিশেষ করে যারা এই কাঠামোয় থাকতে চায় না, তাদের জন্য৷ কিন্তু নিজে না চাওয়া একটা বিষয়, অন্যদের এগিয়ে যেতে বাধা দেওয়া একেবারে আলাদা একটি বিষয়৷''
‘ইউরোই ইইউ'র কেন্দ্রবিন্দু'
বলাই বাহুল্য, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারোসো গোটা রাষ্ট্রজোটকে ধরে রাখতে চান৷ যারা ইউরো এলাকাকে ইইউ থেকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে দেখে, তিনি তাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, যে ইউরোজোন আসলে ইউরোপীয় ইউনিয়নেরই কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে৷ এসম্পর্কিত চুক্তির মধ্যেই বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়া আছে৷ যারা এখনো ইউরোজোনের অন্তর্গত নয়, তারাই ব্যতিক্রম৷ দুর্বল সদস্যদের এই রাষ্ট্রজোট থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাবের মধ্যে বিশাল বিপদ লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে করেন বারোসো৷ তিনি বললেন, ‘‘আমরা যদি গোটা বিশ্বের কাঠামোর মধ্যে গণতন্ত্র সত্যি টিকিয়ে রাখতে চাই, তাহলে আমাদের সদস্য রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সম্পূরক হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের গণতন্ত্রকেও অক্ষত রাখতে হবে৷ তা না হলে আসল সার্বভৌমত্ব আর্থিক বাজারের হাতে চলে যাবে৷ সেক্ষেত্রে সদস্য দেশগুলিও তাদের সার্বভৌমত্ব হারাবে৷ সেই ক্ষমতা চলে যাবে বাজার, ফাটকাবাজ ও গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা এমন সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে, যাদের উপর কারো কোনো গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ নেই৷ একারণেই আমাদের ইউরোপীয় গণতন্ত্রকে আরও মজবুত করে তুলতে হবে৷''
অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট বারোসোর এমন জ্বালাময়ী বক্তৃতা সত্ত্বেও সংকট নিয়ে সংশয় কাটছে না৷ এর মধ্যে ইইউ'র মুদ্রা বিষয়ক কমিশনর অলি রেন বর্তমান সংকটের সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কেও সতর্ক করে দিয়েছেন৷ তাঁর মতে, আর্থিক সংকট নিয়ে এত ব্যস্ততার মাঝে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয়টি প্রয়োজনীয় গুরুত্ব পাচ্ছে না৷ ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি ছাড়া কোনো দেশ বা এলাকাই দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য ধরে রাখতে পারে না৷ বিগত কয়েক বছর ধরে জার্মানির মতো হাতে গোনা কিছু দেশ সামান্য হলেও প্রবৃদ্ধির পথে চলেছে বটে, কিন্তু বর্তমান সংকটের ফলে গোটা ইউরোপের অর্থনীতি বেসামাল হয়ে পড়েছে৷ ফলে ইউরোপ জুড়ে মন্দার আশঙ্কা আর উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না৷ সবাই ঠিকমতো নিজেদের ঘর গোছাতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে ইউরোপ আরও বড় সংকটের মধ্যে তলিয়ে যাবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন অলি রেন৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক