যুদ্ধে যাবেন না মোদী
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলোতে কিছু রসিকতা খুব চালু৷ যেমন ভারত যখন চাঁদে মহাকাশচারী পাঠাবার কথা ভাবছে, প্রতিবেশী পাকিস্তান তখন ভাবছে, কীভাবে কাশ্মীরে আরও কটা ফিদায়েঁ জঙ্গি পাঠানো যায়! অথবা ভারত সারা পৃথিবীতে দক্ষ তথ্য-প্রযুক্তি পেশাদার জোগান দেয়, আর পাকিস্তান প্রতিবেশী দেশগুলোতে জোগান দেয় সন্ত্রাসবাদ! ভারতের টেক-স্যাভি প্রধানমন্ত্রী হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, টুইটার, ইত্যাদি ভার্চুয়াল সামাজিক অঙ্গনে নিয়মিত যাতায়াত করেন৷ তিনিও নিশ্চয়ই এই রসিকতাগুলো সময় সময় পেয়ে থাকেন৷ কারণ সদ্য এক ভাষণে মোদী এই রসিকতার ভাষাতেই খোঁচা মারলেন পাকিস্তানকে৷ কেরলের কোঝিকোড়ে বিজেপি-র দলীয় সমাবেশে মোদী সংঘ পরিবারের তাত্ত্বিক নেতা দীনদয়াল উপাধ্যায়কে উদ্বৃত করে বললেন, ভারতীয় মুসলিমদের ঘৃণাও নয়, তোষণও নয়৷ বরং তাদের জনজীবনের মূল ধারায় সামিল করতে হবে৷ বিকাশের অংশ করতে হবে৷ ভারত-পাকিস্তান বিরোধের সূত্র ধরে দেশে যাতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার কথাও বললেন নরেন্দ্র মোদী৷
শুনে মনে হচ্ছে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ঠেকাতে, দেশে ফেনিয়ে ওঠা যুদ্ধবাদী উত্তেজনা প্রশমনে তৎপর হয়েছেন খোদ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী৷ নাগরিকদের একাংশের মধ্যে যে যুদ্ধ যুদ্ধ রব উঠেছে, মিডিয়ার একাংশ যেভাবে সেই গণ হিস্টিরিয়ায় ইন্ধন জোগাচ্ছে, তার একেবারে বিপরীত মেরুতে ভারতের সরকারপ্রধানের এখনকার অবস্থান৷ দেশের প্রাক্তন সেনাকর্তারা কেউ যেখানে ভারতীয় ফিদায়েঁ গেরিলা বাহিনী তৈরির বালখিল্য পরামর্শ দিচ্ছেন, বা ইসরায়েলি কায়দায় ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক', অর্থাৎ অস্ত্রোপচারের সূক্ষ্মতায় সামরিক হামলার নিদান হাঁকছেন, সেখানে হিন্দুত্ববাদী সরকারের প্রধান সম্পূর্ণ উলটো কথা বলছেন! অবশ্য কোঝিকোড়ের দলীয় সভায় প্রধানমন্ত্রী এ কথাও বলেছেন যে পাঠানকোট এবং উরি সেনা ছাউনিতে জঙ্গি হামলার উপযুক্ত জবাব ভারতীয় সেনাবাহিনীই দেবে৷ কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথাগত প্রত্যক্ষ সামরিক সংঘর্ষে ভারত যে যাবে না, এটা প্রধানমন্ত্রীর হাবেভাবে পরিষ্কার৷ যাঁরা এতদিন ভাবছিলেন পঞ্জাব এবং উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের আগে একটা যুদ্ধ বাধিয়ে রাজনৈতিক ফয়দা তোলার চেষ্টা করবে ক্ষমতাসীন বিজেপি, তাঁরাই বরং একটু হকচকিয়ে গেছেন৷
নরেন্দ্র মোদী কেন যুদ্ধ চাইছেন না? কারণটা খুব পরিষ্কার৷ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা ভারত আগেই জিতে বসে আছে৷ সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী এতটা শান্ত থাকতে পারছেন৷ উলটে দেশের মধ্যে যুদ্ধবাদী উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করছেন৷ কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে অযথা একটা সামরিক সংঘর্ষের মধ্যে গিয়ে অর্থক্ষয়, লোকক্ষয়ের কারণ তিনি দেখছেন না৷ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পাকিস্তান এবার কাশ্মীর সমস্যাকে আন্তর্জাতিক ইস্যু করে তুলতে মরিয়া ছিল৷ ভারতের সঙ্গে লাগাতার বিরোধে কাশ্মীরই পাকিস্তানের একমাত্র হাতিয়ার এবং জাতিসংঘের নির্ধারিত অধিবেশনের মাসখানেক আগে থেকেই সেই হাতিয়ারে শান পড়ছিল৷ ভারতীয় কাশ্মীরে তথাকথিত জনরোষে যে নিয়মিত মদত জোগায় পাকিস্তান, এটা আজ আর কোনো গোপন ঘটনা না৷ গত এক মাস ধরে কাশ্মীরে জনরোষের আগুনে তাই নিয়ম করে ইন্ধন জোগানো হয়েছে৷ পরিণতিতে বহু মানুষ মারা গেছেন, বহু জখম, ভারতীয় সেনার ছররা গুলিতে অনেকেই অন্ধ হয়ে গেছেন৷ এই গণ আন্দোলনকেই জাতিসংঘের ভাষণে তুলে ধরে ভারতীয় সেনা বর্বরতার দিকে আন্তর্জাতিক নজর ফেরাতে চেয়েছিল পাকিস্তান৷ এবং শেষ কৌশল হিসেবে ঘটানো হলো উরি সেনা ছাউনিতে জঙ্গি হামলা প্রত্যাঘাত করবে ভারত, এমনটাই আশা ছিল পাকিস্তানের৷
অবশ্য রণকৌশল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনও হতে পারে যে উরি হামলা পাকিস্তানের পরিকল্পনায় ছিল না৷ জঙ্গিদের সমস্ত উৎপাতের ওপর যেহেতু নিয়ন্ত্রণ থাকে না, হতেই পারে যে জঙ্গিরা একক সিদ্ধান্তে এই হামলা করেছে, যা কার্যত জল ঢেলে দিয়েছে পাকিস্তানের যাবতীয় কাশ্মীর-প্রস্তুতিতে৷ যে কারণে জাতিসংঘের অধিবেশন সেরে ফেরার পথে লন্ডনে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের সামনে অমন একটা বেফাঁস মন্তব্য করে ফেলেছেন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ যে, কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাসন্ত্রাসের বদলা নিতেই সম্ভবত উরি হামলা৷ বোঝাতে চেয়েছেন, এ হলো ভারতের কর্মফল৷ কিন্তু তার আগেই যা হওয়ার হয়ে গেছে৷জাতিসংঘে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে শোরগোল ফেলা দূরে থাক, কার্যত নিঃসঙ্গ হয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শরিফ৷ কারণ বাকি সব সদস্য দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, ভারতকে যেভাবে লাগাতার জঙ্গি সন্ত্রাসের মোকাবিলা করতে হচ্ছে, সেই নিয়ে৷ এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মত গঠিত হয়েছে দ্রুত৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন পাকিস্তানকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনতে চেয়েছে৷ অ্যামেরিকায় আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানদের মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও পাকিস্তানের প্রশ্নে তারা এক জায়গায় এসেছে৷ দুই শিবিরের দুই সেনেটর মার্কিন প্রতিনিধিসভায় যৌথ প্রস্তাব এনেছেন, পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের মদতদাতা দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হোক৷ দক্ষিণ এশিয়ার সব প্রতিবেশী দেশ, বিশেষত বাংলাদেশ জঙ্গি হামলার নিন্দা করে ভারতের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷ এমনকি চীনও পাকিস্তান আক্রান্ত হলে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে জঙ্গিপনার নিন্দা করেছে৷
কিন্তু কে আক্রমণ করবে পাকিস্তানকে? ভারত নয়৷ নরেন্দ্র মোদী নিশ্চিত মরার ওপর খাঁড়ার ঘা দিতে চাইবেন না৷ কারণ পাকিস্তানকে ফের আন্তর্জাতিক মহলে একঘরে করার কাজে ভারত সফল৷ ওদিকে বালোচিস্তানের স্বাধীনতার দাবিকে সমর্থন জানিয়ে পাকিস্তানকে আরও কোণঠাসা করার চেষ্টাও শুরু হয়েছে৷ পুরনো বন্ধু আফগানিস্তানকে নিয়ে ভারতের চিন্তা নেই৷ বরং ভারত এখন বেশি মনোযোগী নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ফাঁকফোকর খুঁজে বের করতে৷ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার কোনো দরকারই নেই ভারতের৷ দেশের মধ্যে মহারাষ্ট্র নির্মাণ সেনার মতো উগ্রবাদী সংগঠন পাকিস্তানি শিল্পীদের বিরুদ্ধে জিগির তুলবে, যেমন এর আগে হয়েছে গজল শিল্পী গুলাম আলির ক্ষেত্রে৷ বা সিন্ধু নদের জল ভাগ করা বন্ধ করে দেওয়ার দাবি উঠবে৷ সংবাদমাধ্যমের একাংশ যুদ্ধ যুদ্ধ বলে বাজার গরম করবে৷ গণ উত্তেজনার গরম হাওয়া বেরিয়ে যেতে দেওয়ার জন্যে সেটুকু অসভ্যতা করতে দেবে নরেন্দ্র মোদীর সরকার৷ কিন্তু যুদ্ধ করবে না৷ করার কোনো কারণ নেই৷
শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা
দেবারতি গুহ
আপনার কী মনে হয়? ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কি আসন্ন? লিখুন নীচের ঘরে৷