যেভাবে, যতটা নির্বাচনের মাঠে জাতীয় পার্টি
২২ ডিসেম্বর ২০২৩শুক্রবার ঢাকা থেকে রংপুরে গেছেন তিনি৷ প্রথমে সরকারি সুবিধা নিয়ে বিমানে রংপুরে যেতে চাইলেও আচরণবিধির কারণে পরে সড়ক পথে যেতে হয় তাকে৷ তবে উপনেতার জন্য বরাদ্দ ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়েই গেছেন তিনি৷
জি এম কাদেরসহ জাতীয় পার্টির কোনো কোনো নেতা সেভাবে প্রচারে না নামলেও কাদেরের স্ত্রী শেরীফা কাদেরসহ জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন প্রার্থী ইতিমধ্যে মাঠে নেমেছেন৷
জাতীয় পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা সবাই নির্বাচনি প্রচারে নেমেছি৷ আমি নিজেও প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে এলাকায় অবস্থান করে জনসংযোগ করছি৷ ভোট পর্যন্ত আমি এলাকাতেই থাকবো৷ আমাদের সব নেতাই যার যার এলাকায় চলে গেছেন নির্বাচনি প্রচারে৷”
নাটকীয়তা শেষে ১৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে থাকার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে জাতীয় পার্ট (জাপা)-র মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু দাবি করেছিলেন, ২৮৩টি আসনে দলের প্রার্থীরা ‘লাঙ্গল' প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন৷ তবে ঢাকা-৬ আসনে দলটির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ এবং ঢাকা-১৩ আসনে প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টুসহ ২৬ জন ঐদিনই নিজেদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন৷ ফলে শেষ পর্যন্ত দেশের ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৫৭টিতে জাপার প্রার্থী থাকে৷ এই ২৫৭ জনের মধ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন-সমঝোতায় জাপার যে ২৬ জন প্রার্থীর আসনে ‘নৌকা'র প্রার্থী নেই, তারা নিজ এলাকায় ভোটের মাঠে সক্রিয়৷ অবশিষ্ট ২৩১ জনের মধ্যে আট-দশ জন নিজ আসনে ‘নৌকা'র বিপরীতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে জোর প্রচারণায় নেমেছেন৷ বাকিরা বলতে গেলে নামেমাত্র প্রার্থী৷ তাদের মধ্যে অনেকেই কার্যত ভোটের মাঠেই নেই৷
জাপার একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের লক্ষ্য বিরোধী দলের অবস্থান নিশ্চিত করা৷ কারণ, জাতীয় পার্টির চেয়ে সতন্ত্র প্রার্থী বেশি পাশ করলে বিরোধী দলের জায়গাটাও হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তাদের৷
তফসিল ঘোষণার পর থেকে জি এম কাদের এলাকায় না যাওয়ায় নানা ধরনের সমালোচনা হচ্ছিল৷ ওই আসনে ইতিমধ্যে প্রচারণার আলো কেড়েছেন আনোয়ারা ইসলাম রানী৷ তৃতীয় লিঙ্গের এই প্রার্থী নির্বাচনি এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন৷ আওয়ামী লীগের অনেকেই তাকে সমর্থন করছেন বলে স্থানীয় পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে৷
আনোয়ারা ইসলাম রানী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "রংপুরের মানুষ বারবার জাতীয় পার্টিকে ভোট দিয়েছে৷ কিন্তু বিনিময়ে কী পেয়েছে? কিছুই পায়নি৷ জিএম কাদের এখনও এলাকায় যাওয়ারই সুযোগ পাননি, তাহলে তিনি নির্বাচিত হলে কিভাবে মানুষের পাশে থাকবেন? আমার পক্ষে এলাকায় জোয়ার উঠেছে৷ সাধারণ মানুষ টাকা দিয়ে আমার পোষ্টার বানাচ্ছে, প্রচারণা চালাচ্ছে৷ যদি আমার সঙ্গে অন্যায় করা না হয়, তাহলে আমি এক লাখ ভোটের ব্যবধানে পাশ করবো৷”
তবে রানীর এসব বক্তব্যকে আমলেই নিতে রাজি নন জাতীয় পার্টির নেতারা৷ রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও রংপুর মহানগরের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "জিএম কাদের এলে জিতবেন, একদিনও না এলেও জিতবেন৷ এটা তো একটা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন৷ বড় দুই-তিনটি দল নির্বাচন করছে না৷ বিএনপি যদি নির্বাচনে থাকতো, তা হলেও এখানে জাতীয় পার্টি জিততো৷ এবার ভোটারদের মধ্যে খুব একটা উৎসাহ নেই৷ ভোট কাস্ট খুব একটা বেশি হবে না৷ তারপরও যা ভোট পড়বে, তার ৮০ ভাগই পাবেন জি এম কাদের৷ সিটি কর্পোরেশনের ভোটে তো দেখেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে৷ এই আসনটা মূলত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের আসন৷ এরশাদ যখন চেয়ারম্যান ছিলেন তখন তিনি এমপি ছিলেন৷ রওশন এরশাদ যখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হলেন, তখন তিনি এখান থেকে এমপি হয়েছেন৷ এখন জি এম কাদের চেয়ারম্যান, তিনি এখান থেকে এমপি হবেন৷”
আওয়ামী লীগ ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোতে সহযোগিতা করছে কিনা জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান ও রংপুর মহানগরের সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসির ডয়চে ভেলেকে বলেন, "রংপুরে আমাদের আওয়ামী লীগের কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন নেই৷ সদর আসনে তো আওয়ামী লীগ নেতারা তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার কথা বলছেন৷ অনেকে তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থীর পক্ষেও মাঠে নেমেছেন৷ তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না৷ আর জি এম কাদেরকে কেন এলাকায় আসতে হবে? জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা আছেন না? তিনি একটা দলের প্রধান৷ তিনি তো সারা দেশে লাঙ্গলের পক্ষে প্রচারণা চালাবেন৷”
তবে রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাজেদ আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রংপুর সদরে আমাদের কোনো প্রার্থী নেই৷ এতদিন জাতীয় পার্টি আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি, ফলে আমরাও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি৷ শুক্রবার তারা কায়েক জায়গায় প্রচারণার কাজে আমাদের ডেকেছে, আমাদের নেতা-কর্মীরা তাদের পক্ষেই প্রচারণা চালিয়েছে৷ তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না৷”
এদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন-সমঝোতার বাইরে থাকা জাতীয় পার্টির ২৩১ জন প্রার্থীর মধ্যে দশ জনের মতো প্রার্থী ‘লাঙ্গল' প্রতীক নিয়ে নিজ আসনে নৌকার বিপরীতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন৷ তাদের মধ্যে রয়েছেন জাপার কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা (ঢাকা-৪) ও সালমা ইসলাম (ঢাকা-১), জাপার সাবেক মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের স্ত্রী এবং পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসরিন জাহান রত্না (বরিশাল-৬), প্রেসিডিয়াম সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা (নারায়ণগঞ্জ-৩), পীর ফজলুর রহমান (সুনামগঞ্জ-৪) এবং হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন (ঢাকা-৭)৷
প্রচারণার শুরুতেই বিতর্কের মুখে জি এম কাদের
সরকারি সুবিধা নিয়ে রংপুরে ভোটের প্রচারে যেতে চেয়েছিলেন জি এম কাদের৷ বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে তিনি ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি'৷ নির্বাচন আচরণ বিধিমালার ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনি প্রচারে সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সরকারি কর্মসূচির সঙ্গে নির্বাচনি কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ড যোগ করতে পারবেন না'৷ শনিবার বিমানে তার যাওয়ার কথা থাকলেও সমালোচনার মুখে শুক্রবার সড়কপথেই তিনি রংপুরে গেছেন৷
গত বৃহস্পতিবার বিরোধী দলীয় উপনেতার কার্যালয়ের চিঠিতে জি এম কাদেরের রংপুর যাত্রাকে সরকারি সফর বলা হয়৷ তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সফরসঙ্গী হবেন জানিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে৷ বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা, বেতন-ভাতা এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন জি এম কাদের৷ তার সফরের খরচ বহন করে সরকার৷
উপনেতার সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আবু তৈয়ব স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, শনিবার সকাল ৯টায় উত্তরার বাসভবন থেকে সড়ক পথে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে যাবেন জি এম কাদের৷ ব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক এবং মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনারকে জানানো হয়েছে৷ শনিবার সকাল ১০টায় বিমানে জাপা চেয়ারম্যান ঢাকা থেকে সৈয়দপুর যাবেন৷ ব্যবস্থাপনার জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছে৷ সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে সড়ক পথে রংপুরের নির্বাচনি এলাকায় যাবেন জি এম কাদের৷ যে পথ দিয়ে তিনি যাবেন, ওই এলাকার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের ব্যবস্থাপনার জন্য বলা হয়েছে৷ আগামী সোমবার ফিরতি যাত্রায় অনুরূপ ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছে৷
সরকারি সফরে নির্বাচনি প্রচারে যাওয়ার সমালোচনা শুরু হওয়ায় একদিন আগে, শুক্রবার দুপুরেই জি এম কাদের সড়কপথে রওনা হন৷ উপনেতার সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আবু তৈয়ব ডয়চে ভেলেকে বলেন, "শুক্রবার দুপুরেই তিনি সড়কপথে রওনা হয়েছেন৷ সোমবার তিনি ঢাকায় ফিরবেন৷ এটা সরকারি সফর না৷ উনি ব্যক্তিগত সফরে নির্বাচনি প্রচারণায় রংপুরে যাচ্ছেন৷”
প্রসঙ্গত, গত ২০ অক্টোবর মুদ্রিত আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সংসদ উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতা, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী এবং তাদের সমমর্যাদার কোনো ব্যক্তি, এমপি এবং সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি৷ ১৪(১) উপধারা অনুযায়ী, সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ভোটের প্রচারে সরকারি যানবাহন, প্রচারযন্ত্র এবং অন্য কোনো রকম সরকারি সুবিধা ভোগ করতে পারবেন না৷ সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহার করতে পারবেন না৷ তবে জি এম কাদের উপনেতার জন্য বরাদ্দ ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে রংপুর গেছেন৷