ব্লগে রবীন্দ্রসংগীত
২৭ নভেম্বর ২০১২‘‘আমি বাংলা ভালবাসি,
আমি বাংলার, বাংলা আমার
ওতপ্রোত মেশামেশি৷''
এভাবে অনেক বাঙালির প্রাণের কথাই লিখে রেখে গেছেন রমেশ শীল৷ আনন্দময়ী মজুমদার আর রুমেলা সেনগুপ্তর সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়নি৷ তবে নিশ্চিত জানি, জানতে চাইলে তাঁরা সমস্বরেই বলতেন এ তাঁদেরও মনের কথা৷
নয় নয় করেও বাঙালির অর্জন কিন্তু অনেক৷ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে বাঙালি, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের গৌরবে তাই শুধু বাংলা৷ আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ঐশ্বর্য বিপুল৷ মধুসূদন দত্ত সেই কবে লিখে গেছেন ‘‘হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন...'', সঙ্গে অবশ্য ‘‘অবহেলা করি, পর ধন লোভে মত্ত করিনু ভ্রমন''-এর আক্ষেপও ছিল৷ রাজশাহীর মেয়ে আনন্দময়ী আর কলকাতার রুমেলাকে সেরকম আক্ষেপে পুড়তে হয়নি৷ তাঁরা বরং দেশের বাইরে গিয়ে বাংলার ঐশ্বর্য ছড়িয়েছেন বিদেশিদের মাঝে!
জন্ম দু'দেশে৷ ওইটুকু বাদ দিলে আনন্দ আর রুমেলার মিলই বেশি৷ দুজনেরই পড়াশোনা পরিসংখ্যান নিয়ে৷ এ বিষয় নিয়ে পড়তে আনন্দ গিয়েছিলেন কলকাতায়৷ তো ইনডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে পড়ার সময়ই রুমেলার সঙ্গে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব৷ তাঁদের এ বন্ধুতাকে অন্য এক উচ্চতায় তুলে নিয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান৷
গান, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গান ভালোবাসেন দুজনই৷ কলকাতায় একসঙ্গে লেখাপড়ার অধ্যায় চুকে যাওয়ার পরও তাই দুজনে মিলে করেছেন নুতন এক অধ্যায়ের সূচনা৷ রবীন্দ্রসংগীতের ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে ব্লগ http://gitabitan-en.blogspot.com এর কথা এখনো যাঁরা জানেন না, তাঁদের অনেকেরই শুনলে হয়তো বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে, রুমেলা আর আনন্দর যৌথ প্রয়াসের ফসল এই ব্লগটি এখন সাড়ে সাতশরও বেশি ইংরেজি রবীন্দ্রসংগীতের ভান্ডার৷
কবিগুরুকে নিয়ে গবেষণা, তাঁর সৃষ্টিকর্মের নানা ভাষায় অনুবাদ শুরুর শতবর্ষ পূর্ণ হতে বোধ হয় খুব বেশি বাকি নেই৷ ১৯১৩ সালের আগে চর্চা, গবেষণা, অনুবাদ কিছুই তো খুব একটা হয়নি, যা হয়েছে সবই বলতে গেলে সে বছর, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার পর থেকে৷ একটা বিষয় আনন্দময়ীকে খুব অবাক এবং হতাশ করেছিল ২০০৯ সালে৷ ঢাকার এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা তখন পিএইচডি করতে গিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে৷ গান শুনতে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন গাইতেও৷ রবীন্দ্রসংগীত এত ভালোবাসেন যে গীতবিতানটা সবসময় সঙ্গে থাকা চাই-ই চাই৷ কানেকটিকাট ইউনিভারসিটিতে কাটিয়ে আসা ওই সময়েও এ নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি৷ আনন্দময়ী জানালেন তখন গীতবিতান দেখে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গিয়েই ধীরে ধীরে জড়িয়ে যান অনুবাদের কাজে৷ বলেন, ‘‘আমি যখন পিএইচডি করতে যুক্তরাষ্ট্রে গেলাম, সেখানে অ্যামেরিকান বন্ধুরা (রবীন্দ্রসংগীত) শুনে জানতে চাইতো কী গান গাইছো? এর মানে কী ? সেই সূত্রে অনুবাদ করে তাঁদের বোঝানোর একটা চেষ্টা শুরু করেছিলাম৷ এভাবেই ব্যাপারটার শুরু৷''
রুমেলারও একই গল্প৷ নেদারল্যান্ডসে গিয়েছিলেন চাকরি করতে৷ গড়পরতা মানুষদের মতো তিনিও কাজ আর চটুল আনন্দ-ফূর্তিতে ডুবে থাকেননি৷ আনন্দময়ীর মতো অবসরে তাঁরও আন্দের উৎস হয়ে ওঠে রবীন্দ্রসংগীত৷ সেখানে শ্রোতা প্রধানত ডাচ বন্ধুরা৷ একসময় তাঁরাও ডুবে যান রবীন্দ্রসংগীতের মোহনীয় সুরে৷ ডাচদের উত্তরোত্তর বেড়ে চলা কৌতুহল মেটাতে সেই যে অনুবাদ শুরু করলেন আর থামেননি রুমেলা৷ রবীন্দ্রসংগীত ইংরেজিতে অনুবাদ করতে করতে এক পর্যায়ে মনে হলো এভাবে আলাদাভাবে না করে দুই বন্ধু এক জায়গায় একসঙ্গে করলেই ভালো৷ রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বেশি গানের অনুবাদের সংগ্রহশালা http://gitabitan-en.blogspot.com সেই ভাবনারই ফসল৷
ব্লগের যাত্রা শুরু সম্পর্কে রুমেলা বলছিলেন, ‘‘২০০৯ সালের অক্টোবরে ব্লগ শুরু হয়৷ আনন্দ আগে থেকেই অনুবাদ করতো৷ আমি জানতাম ওর কাছে একটা পিডিএফ ফাইলে গানগুলোর অনুবাদ ছিল৷ তো আমার মনে হলো, আমিও যেহেতু অনুবাদ করছি, তাই দুজনে একসঙ্গে করলে পাঠকদের জন্য এক জায়গায় অনেকগুলো গানের ব্যবস্থা করতে পারবো৷ সেই ভাবনা থেকেই ব্লগ শুরু৷''
সেই ব্লগে এখন ৭৬০টি রবীন্দ্রসংগীতের অনুবাদ৷ আনন্দময়ী খুব আত্মবিশ্বাস নিয়েই দাবি করলেন তাঁদের জানা মতে এত বেশি রবীন্দ্রসংগীতের ইংরেজি অনুবাদ আর কেউ আগে করেননি৷ বাকে, উইলিয়াম রাদিচে, কেতকি কুশারি ডাইসন, অমীয় চক্রবর্ত্তী, ক্ষিতীশ রায়সহ অতীতে যে অনেকেই রবীন্দ্রনাথের গান অনুবাদ করেছেন তা আনন্দময়ীরও জানা৷ এমনকি সম্প্রতি যে ‘এসেন্শিয়াল টেগোর' একটি বই বাংলাদেশের ফখরুল আলম আর পশ্চিম বঙ্গের রাধা চক্রবর্ত্তীর সম্পাদনায় বেরিয়েছে সেখানে যে কিছু গানের অনুবাদ আছে সেটাও অজানা নয়৷ কারো ইংরেজিতে অনুদিত রবীন্দ্রসংগীতের সংখ্যাই একশ-র বেশি নয়৷ আনন্দময়ী আর রুমেলা কিন্তু গুণগত মান বা শুদ্ধতার ব্যাপারটিকে অগ্রাহ্য করে সংখ্যায় সবাইকে ছাড়িয়ে যাবার লড়াইয়ে নামেননি৷ কাজ করছেন প্রাণের তাগিদে৷ অনুবাদ সম্পর্কে পাঠকের মতামত, সমালোচনা জানতে একটা ‘ডিসকাশন ফোরাম' খুলেছেন ফেসবুকে৷ নাম ‘থটস অব টেগোর'৷
কোনো স্বীকৃতি বা পুরষ্কারের আশায় যে কাজ করেন না এ কথা স্পষ্ট করেই জানালেন রুমেলা৷ বাংলা ভাষা ভাষী নন -এমন পাঠকদের কাছে যত বেশি সম্ভব পৌঁছানোটাই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য৷
সে লক্ষ্যে মাত্র ৩ বছরেই অনেক দূর এগিয়েছেন বলে আনন্দময়ী আর রুমেলা বেশ খুশি৷ নেদারল্যান্ডস প্রবাসী রুমেলা জানালেন খুব দ্রুত রবীন্দ্র সংগীতের ইংরেজি অনুবাদকে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দিতে পারার আনন্দের কথা, ‘‘সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ইউকে, জার্মানি, ইউএসএ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া থেকে পেজ ভিউ হবে এটা আমি জানতাম, কারণ এসব দেশে প্রচুর বাঙালি আছে, কিন্তু এখন দেখছি স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোতেও প্রচুর হিট হচেছে৷ সুইডেন, নরওয়ে, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সৌদি আরবের মতো জায়গাতেও বেশ সাড়া পাচ্ছি৷''