রাজনীতি না থাকলেও মারামারি আছে
১৬ অক্টোবর ২০২১গত মাসে দেশের বিভিন্ন জেলায় অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও আওয়ামী লীগ ও তাদের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচনের দিন সংঘাতে তিনজন নিহত হয়েছেন৷ আর আসছে ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে মাগুরায় চারজন নিহত হয়েছেন৷
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর এই ৯ মাসে সারাদেশে রাজনৈতিক সংঘাতে নিহত হয়েছেন ৬৪ জন৷ নিহতের এ সংখ্যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি৷ গত বছর সারাদেশে রাজনৈতিক সংঘাতে ৩১ জন নিহত হয়েছেন৷ তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে নিহত হয়েছেন পাঁচজন৷
চলতি বছরের ৯ মাসে সারাদেশে ৩২১টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে৷ এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন চার হাজার ৪০৫ জন৷ এসময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ৬টি৷ তাতে ৭২ জন আহত হয়েছেন৷ আর মারা গেছেন তিনজন৷
সংস্থাটির হিসেব অনুযায়ী, উল্লেখিত সময়ে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর ভেতরে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা বেশি৷ মোট সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ৮৩টি৷ তাতে নিহত হয়েছেন ১২ জন, আর আহত হয়েছেন ৯৬৯ জন৷
বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে চারটি৷ আহত হয়েছেন ১০ জন৷ নিহত হয়েছেন এক জন৷ তবে পুলিশের সাথে তাদের সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ১৮টি৷ আহত হয়েছেন ৫৫০ জন৷ আওয়ামী লীগের সাথেও পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে৷ মোট তিনটি ঘটনায় আহত হয়েছেন ৯৬ জন৷
এদিকে, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে ৯টি৷ নিহত হয়েছেন পাঁচজন৷ আহত ৮৭ জন৷
চলতি বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনি সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে৷ কয়েক ধাপের ইউপি নির্বাচনে ১৬৭টি সংঘাতের ঘটনায় ৩০ জন নিহত হয়েছেন৷ আহত হয়েছেন এক হাজার ৯৪২ জন৷ পৌর নির্বাচনে ১০টি সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে৷ তাতে নিহত হয়েছেন একজন৷ আহত হয়েছেন ১১৮ জন৷ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৬টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন তিন জন৷ আহত ১৬২ জন৷
এছাড়া জাতীয় পার্টি, জাসদসহ আরো অনেক ছোট ছোট রাজনৈতিক দলও সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে৷
বিশ্লেষণে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাতের মূল কারণ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, বহিরাগতদের আধিপত্য, ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং, দলীয় পদ নিয়ে সমস্যা প্রভৃতি৷ আর বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাতের কারণ অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দলের পদ-পদবী, দলে আধিপত্য প্রভৃতি৷ স্থানীয় সরকার বিশেষ করে ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যেই সংঘাত বেশি হয়েছে৷
অর্থাৎ করোনার সময় দেশে মাঠের রাজনীতি খুব একটা দেখা না গেলেও, রাজনৈতিক সংঘাত বেড়েছে৷ করোনার আগের বছর যেখানে সংঘাতে মারা গেছে পাঁচজন সেখানে করোনার বছর ২০২০ সালে ৩১ জন আর চলতি বছরের অর্থাৎ ২০২১ সালের প্রথম নয় মাসেই ৬৪ জন নিহত হয়েছেন৷
আসক-এর সাধারণ সম্পাদক এবং মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, ‘‘দিন দিন আদর্শিক রাজনীতি দূরে চলে যাওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ দলগুলোর ভেতরে আরেকটি দল, নানা উপদল সৃষ্টি হয়েছে স্বার্থের কারণে৷ আর সেই স্বার্থ নিয়েই দলের নানা উপদল অভ্যন্তরীন সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে৷’’
তার মতে, কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার কারণে সরকার সমর্থক দলে এটা বেশি৷ বিরোধী দলগুলোও রাজনীতি না থাকায় অভ্যন্তরীণ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে৷ আর সব দলেই এখন কম বেশি ব্যক্তি পূজা চলছে৷ ফলে দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা নাই৷ আছে সংঘাত-সংঘর্ষ৷
তিনি বলেন, ‘‘সরকার সমর্থকরা আবার বিরোধী দলকে কোনঠাসা করতে সংঘাতের আশ্রয় নেয়৷ ফলে রাজনীতি না থাকলেও মারামারি-সংঘাত আছে৷ দিন দিন এটা বাড়ছে৷’’
আর সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুদারের বলছেন, ‘‘রাজনীতি এখন জনকল্যাণের জন্য নেই৷ এটা ব্যক্তিস্বার্থের জন্য হচ্ছে৷ তাই প্রকৃত রাজনীতি না থাকলেও সংঘাত-মারামরি আছে৷ এই সংঘাত ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের জন্য৷ ক্ষমতাসীনরা সংঘাত-সঘর্ষ করছে এখন সুবিধা পাওয়ার জন্য৷ কেউ পাচ্ছে আবার কেউ কম পাচ্ছে বা পাচ্ছে না৷ সেটা নিয়ে সংঘাত হচ্ছে৷ আর বিএনপিতে সংঘাত হচ্ছে ভবিষ্যতে পাওয়ার আশায়৷ তারা ক্ষমতায় গেলে কার আধিপত্য থাকবে, কে বেশি পাবে তার লড়াই চলছে এখন৷’’
তিনি বলেন, ‘‘রাজনীতি মানে হচ্ছে দেওয়া৷ দেশের মানুষকে, জনগণকে দেয়া৷ কিন্তু এখন হচ্ছে নিজের পাওয়ার রাজনীতি৷ নিজের স্বার্থের রাজনীতি৷’’
এর পরিণতি খুব খারাপ হবে বলেও সতর্ক করেন তিনি৷