শরীরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা কেবল মনে নয়, শরীরেও বহন করে চলেছেন যুদ্ধের স্মৃতি৷ কারো মনে হতাশা কাজ করলেও দেশ স্বাধীন হয়েছে, বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, এটাই তাদের সান্ত্বনা৷ চলুন শুনি একাত্তরের কয়েকজন যুদ্ধাহতের গল্প৷
মানচিত্র ও পতাকাতেই তৃপ্তি
কুমিল্লার সৈয়দ জানে আলম সাচন মুক্তিযুদ্ধ করেছেন চার নম্বর ও দুই নম্বর সেক্টরে। রাঙাউটি সীমান্তে যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের গুলি তার বাম হাতে আঘাত হানে, বিচ্যূত হয়ে যায় মেরুদণ্ডের হাড়। সেসময় ভারতে চিকিৎসা নিলেও সুস্থ হননি পুরোপুরি৷ দুটো লাঠি বা হুইলচেয়ার ছাড়া তিনি চলতে পারেন না। তবে এ নিয়ে তার আফসোস নেই। লাল-সবুজের পতাকা ও মানচিত্রই তাকে তৃপ্তি দেয়৷
‘কিছু পাওয়ার জন্য তো যুদ্ধে যাইনি’
রাজশাহীর মো. বাকি মোল্লা যুদ্ধ করেন সাত নম্বর সেক্টরে। জুন মাসে বাসুদেবপুরে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। ডান পা হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলা হয়। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে জানতে পারেন অন্তঃসত্তা স্ত্রী মারা গেছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুবিধা পাওয়া নিয়ে কথা শুনতে হয় বলে দুঃখ করে বলেন, ‘‘কিছু পাওয়ার জন্য তো যুদ্ধে যাইনি। কিন্তু আজ যদি এক কোটি টাকা দিয়ে আপনার একটা পা কেটে ফেলতে চাই, আপনি কী দেবেন?’’
‘‘দেশের জন্য রক্ত দিতে পেরে গর্বিত’’
বরিশালের সার্জেন্ট মোহাম্মদ কাঞ্চন সিকদার একাত্তরে সেনাবাহিনীর সিপাহী ছিলেন। যুদ্ধ করেছেন নয় নম্বর সেক্টরে৷ ১৯৭১-এর ২২ অক্টোবর গৌরনদীর বাটাজোরে পাকিস্তানি ক্যাম্প দখলের সময় ব্রাশফায়ারে তার বাম পা মারাত্মক জখম হওয়ায় হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলতে হয়। এখন হুইল চেয়ার ও কৃত্রিম পায়ের সহায়তায় চলাফেরা করেন। দেশের জন্য রক্ত দেওয়ার সুযোগ পাওয়ায় গর্বিতএই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
‘দেশ পাইসি, আর দুঃখ নাই’
গোপালগঞ্জের আলিউজ্জামান যুদ্ধ করেছেন আট নম্বর সেক্টরে, হেমায়েত বাহিনীর অধীনে৷ ঘাগোরে এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের গুলি তার মাথায় লাগায় ডান চোখ হারাতে হয়। তার ভাষায়, ‘‘গাড়ি পামু, টাকা পামু, বাড়ি পামু- এমন চিন্তা তো একাত্তরে ছিল না। চিন্তা ছিল একটাই, পাকিস্তানিগো এই দেশ থেকে তাড়াইতে হবে। দেশরে স্বাধীন করতে হবে। সেই দেশ পাইসি। আমার আর কোনো দুঃখ বা কষ্ট নাই ভাই।’’
মনের চোখে দেশকে দেখা
ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার যুদ্ধ করেন দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে ডেমরা, রামপুরা টিভি স্টেশন এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায়। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সাতারকুল অপারেশনে যাওয়ার প্রস্তুতির সময় কায়েদপাড়া ক্যাম্পে মাইন বিস্ফোরণে ডান হাত কনুইয়ের নীচ থেকে উড়ে যায়। মাইনের গ্যাস ঢুকে চোখ দুটিও নষ্ট হয়ে যায়। নিজ চোখে দেখতে পারেননি স্বাধীনতার লাল সূর্যটা। তবুও আফসোস নেই, তিনি দেশকে দেখেন মনের চোখ দিয়ে।
‘একাত্তরডা মনে পইড়া যায়’
সুনামগঞ্জের মান্নান আলী ট্রেনিং নেন ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে। যুদ্ধ করেছেন পাঁচ নম্বর সেক্টরে৷ ৭ ডিসেম্বর ছাতক থানা অপারেশনে সুরমা নদীর তীরে পাকিস্তানি সেনাদের পুঁতে রাখা মাইনের আঘাতে উড়ে যায় ডান পায়ের কিছু অংশ। তবে স্বাধীন দেশই তার আনন্দ৷ ‘‘আমি প্রতিষ্ঠিত হই বা না হই, দেশ তো প্রতিষ্ঠিত হইছে, এটাই বড় পাওয়া। সবচেয়ে ভালcf লাগে ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর আসলে। তখন একাত্তরডা মনে পইড়া যায়।’’
‘দেশ ভাল থাকলেই আমরা ভালো থাকি’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জসিম উদ্দিন শুরুতে চার নম্বর সেক্টরে গেরিলা যুদ্ধ, পরে তিন নম্বর সেক্টরে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। ২৯ নভেম্বর রামরাইল ব্রিজ অপারেশনের সময় পাকিস্তানি সেনাদের ছোঁড়া গুলি লাগে ডান হাতের কবজিতে৷ এখনও শরীরে ব্যথা অনুভব করেন। তবে স্বাধীনতা তাকে ভুলিয়ে দেয় সব দুঃখ। তার ভাষায়, ‘‘মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা দিসে দেশের জন্য, কিছু পাওয়ার জন্য না। দেশ ভাল থাকলেই আমরা ভালো থাকি।’’
‘‘সময়ের প্রয়োজনে যুদ্ধ করেছি’’
নেত্রকোণার মো. ওসমান গণি তালুকদার যুদ্ধ করেন এগারো নম্বর সেক্টরে। ৬ ডিসেম্বর বিজয়পুর ক্যাম্প অপারেশনের সময় মাইনের আঘাতে তার ডান পা হাঁটুর ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। স্প্লিন্টারে বিদ্ধ হয় বাম পা ও ডান হাতের আঙুল। তার ভাষায়, ‘‘সময়ের প্রয়োজনে যুদ্ধ করেছি, সুবিধা পাওয়ার আশায় নয়। আমাদের জন্য এ সরকার অনেক করছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তো রাষ্ট্রীয় কোনো প্রটোকল নাই। এটাই খারাপ লাগে।’’
‘দায়িত্ব ছিল, করে দিছি’
ময়মনসিংহের মোহাম্মদ তারা মিয়া দুই নম্বর সেক্টর এবং ‘বিচ্ছু বাহিনী’তে গোয়েন্দার কাজও করতেন। ১২ ডিসেম্বর ঢাকার অদূরে তারাবোতে আর্টিলারির আঘাতে জখম হয় মেরুদণ্ড। ধীরে ধীরে ক্ষত বাড়তে থাকায় হুইল চেয়ারই একমাত্র ভরসা। তিনি বলেন, ‘‘স্বাধীন হইয়া দেশটা তো একা চলছে, আমি চলছি অন্যের সাহায্যে। রক্ত তো দিতেই হইবো। রক্ত ছাড়া কোনো দেশ স্বাধীন হয় নাই। রক্ত দেওয়ার সুযোগটা আমরা পাইছিলাম। দায়িত্ব ছিল, করে দিছি।’’
‘এই মাটিতে আমাদের রক্তের গন্ধ আছে’
খুলনার লিবিও কীর্ত্তনিয়া যুদ্ধ করেন নয় নম্বর সেক্টরে৷ বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর খুলনা নিউ মার্কেট এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের রকেট শেলের আঘাতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার ডান পা। বর্তমানে এ মুক্তিযোদ্ধার জীবন কাটছে শারীরিক নানা সমস্যায়। তবুও দেশ নিয়ে তৃপ্ত তিনি। বললেন, ‘‘এই মাটিতে আমাদের রক্তের গন্ধ আছে, এটা ভাবলেই মন ভরে যায়। দেশ পেয়েছি এটাই বড় কথা।’’