শিক্ষকের উপাচার্য হওয়া কেন জরুরি?
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯এই উপাচার্যদের কেউ আলোচিত হয়েছেন রাস্তায় কর্মচারীদের দিয়ে ময়লা ফেলে তা পরিস্কার করার অভিনয় করে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থে বিলাসবহুল আসবাব কিনে, কেউ আলোচিত প্রকল্প বাস্তবায়নে ছাত্রলীগকে চাঁদা দিয়ে৷ আলোচনা-সমালোচনায় তাঁদের সবাইকে শেষমেষ ছাড়িয়ে গেলেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিন৷ তিনি তার শিক্ষার্থীদের সাথে যে ভাষায় কথা বলেন তা শিক্ষকসুলভ তো নয়ই, ভদ্রোচিতও নয়৷ তার প্রতিষ্ঠানেরই একজন ছাত্রী ফেসবুকে প্রশ্ন করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী৷প্রশ্নটা ঘুরিয়ে করা যায়, আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাজই বা কী?
স্বাধীনতাপূর্বকালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয় ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ দিয়ে৷ সেখান থেকে মোটামুটি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের দায়িত্ব সম্পর্কে ধারণা মেলে৷ ১২ নম্বার ধারাতে উপাচার্যের ক্ষমতা সম্পর্কে বলা আছে৷ প্রথম কাজ, তিনি একজন প্রধান নির্বাহী এবং অ্যাকাডেমিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, সিনেট, সিন্ডিকেট এবং অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভাপতি হবেন, বিভিন্ন বৈঠকে বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকবেন ইত্যাদি৷ সেখানে কোথাও তার অ্যাকাডেমিক দায়িত্ব কী হবে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই৷ সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আসলে যতটা না শিক্ষক তার চেয়ে বেশি একজন কর্মকর্তা৷ আর এজন্যে তার হাতে আছে বিপুল ক্ষমতাও৷
এই অধ্যাদেশ পড়তে পড়তেই প্রয়াত অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে শোনা একটি গল্প মনে পড়ে গেল৷ তিনি একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেলেন৷ স্যারের শুভানুধ্যায়ীরা গেলেন তাঁকে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানাতে৷ শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীরাও৷ এক পর্যায়ে তিনি বিরক্ত হয়ে তাদের বললেন, ‘‘তোমরা কি আমার কেরানীসুলভ পতনে অভিবাদন জানাতে এসেছ!''
স্যারের এই কথার অনেকটা প্রমাণ পেয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থাতেও৷ বিভাগে যারা চেয়ারম্যান হন, তাদের কেউ কেউ এমনকি আর ক্লাস নেয়ার প্রয়োজনও বোধ করেন না৷ তুলনামূলক আরামদায়ক কক্ষে তিনি বন্দি হয়ে পড়েন, দূরে সরে যান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে৷ বিভাগীয় চেয়ারম্যান হওয়াই যদি হুমায়ুন আজাদ স্যারের কথা অনুযায়ী ‘কেরানীসুলভ পতন' হয় তাহলে ভিসির পদটা কী? ‘মহাকেরানীসুলভ পতন' বললে ভুল কি হবে? যাকে সবই করতে হয়, সম্ভবত শুধু শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কাজটি ছাড়া৷
ভিসিকে কাগজে-কলমে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিলেও পুরো প্রক্রিয়াটি যে রাজনৈতিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ যেই সরকার ক্ষমতায় থাকে তারা তাদের মতানুসারী শিক্ষকদের এই পদে নিয়োগ দেন৷ সেখানে যোগ্যতার কোনো মাপকাঠি নেই৷ উপাচার্য হওয়ার জন্য শিক্ষকরাও তাই উঠে-পড়ে লাগেন, কে কতটা সরকারদলীয় রাজনীতির অনুগত তা প্রমাণে৷ এরপর নিয়োগ যখন পান তখন সেই প্রমাণের মাত্রাটা আরো বাড়াতে হয়৷ সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনকে খুশি রাখতে হয়, অনুসারী শিক্ষক-কর্মচারীদের বিভিন্ন আবদার পূরণ করতে হয়, সরকারবিরোধী বা সমালোচনাকারী শিক্ষকদের চোখে চোখে রাখতে হয়, পদে পদে তাদেরকে হয়রানি করতে হয়, ছাত্রদের কোনো আন্দোলন যেন না হয় সেই নজরদারিটারও প্রয়োজন হয় ৷ উপাচার্যকে সকাল থেকে রাত অবধিই ব্যস্ত থাকতে হয় এসব কর্মকাণ্ডে৷ এমনকি বাসায় ফিরেও নিস্তার পান না তিনি৷ এত কিছুর মাঝে উপাচার্য শিক্ষকতা কিংবা গবেষণার নেতৃত্ব দেবেন কী করে (অবশ্য অধ্যাদেশ অনুযায়ী সেটি তো তার দায়িত্বও নয়)!
এখন চিন্তা করে দেখুন, উপাচার্যকে যা করতে হয় তার জন্য আদৌ সেই পদে কোনো শিক্ষকের প্রয়োজন আছে কিনা৷ বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল আর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সরকার সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেন৷ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বর্তমান বা সাবেক আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার নজিরও আছে৷ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও উপাচার্য হিসেবে এমন কাউকে নিয়োগ দিলে তিনিই বরং মহাকেরনীসুলভ এই দায়িত্বটি ভালো সামলাতে পারবেন৷ তাতে অন্তত শিক্ষক সমাজের মান বাঁচবে৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলতে চান? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷