শিক্ষার্থীদের ‘ঠ্যাঙাতে' কেন ক্যাম্পাসে বার বার পুলিশ?
২১ জানুয়ারি ২০২২তারপরও কেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংকটের সুষ্ঠু সমাধানের পথে না হেঁটে বার বার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘ঠ্যাঙাতে' ক্যাম্পাসের মধ্যেই পুলিশ লেলিয়ে দেয়?
একটি হলের প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবিতে গত ১৩ জানুয়ারি রাত থেকে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে৷ সাত দিনের মাথায় তা বাড়তে বাড়তে এখন শিক্ষার্থীরা উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেছেন৷ মাঝে পেটোয়া বাহিনী দিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বেধড়ক মারধর, ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে গুলি, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে মামলার মত ঘটনা ঘটেছে৷
যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পুলিশ এসে শিক্ষার্থীদের গুলি করে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের তো নিজের অক্ষমতায় নিজে থেকে পদত্যাগ করা উচিত৷
অথচ উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলছেন, সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে তিনি তা মেনে নেবেন৷ কেন সরকার তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন? তবে কি তিনি নিজের যোগ্যতায় নয়, সরকারের পা চেটে উপাচার্য হয়েছেন?
বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী ছাত্রী হলের প্রভোস্ট জাফরিন আহমেদ লিজার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগে শাবিপ্রবি-র আন্দোলন শুরু হয়৷ ওই হলের ছাত্রীরা প্রভোস্টের পদত্যাগ ও ক্ষমা চাওয়ার তিন দফা দাবিতে রাত ১১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিনের বাসভবন ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন৷ সে সময় উপাচার্য তাদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিলে রাতেই ছাত্রীরা হলে ফিরে যান৷ উপাচার্য যদি তার আশ্বাস মতো কাজ করতেন তবে হয়তো সেখানেই সংকটের সমাধান হয়ে যেত৷
সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের পানি, সিট, খাবার, ইন্টারনেট সব কিছু নিয়েই ছাত্রীদের অভিযোগ ছিল৷ অভিযোগ জানাতে ছাত্রীরা হল প্রভোস্টকে হলে যেতে অনুরোধ করেছিল; নিয়ম তো এটাই৷ উচ্চশিক্ষা নিতে বাড়িঘর ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক অভিভাবক তো হল প্রভোস্টই৷
কিন্তু প্রভোস্ট জাফরিন কী করলেন? তিনি ছাত্রীদের বললেন, কেন তিনি সেখানে যাবেন, ‘কেউ তো মারা যায়নি'! তাই তার হলে যাওয়ার ‘ঠেকাও পড়েনি'৷
সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী ছাত্রীদের দাবি, প্রভোস্ট জাফরিন ছাত্রীদের প্রায়ই বলেন, তাদের দয়া করে হলে থাকতে দেয়া হয়, এটাই বেশি৷ এই দয়া করার অধিকার তাকে কে দিলো? শিক্ষার্থীরা নিজেদের যোগ্যতায় এক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন৷ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দেওয়া৷ তাদের দেখভাল করা৷ বিপদ-আপদে বুক দিয়ে আগলে রাখা৷
তা না করে শাবিপ্রবি উপাচার্য ক্যাম্পাসের ভেতর শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে প্রথমে পেটোয়া বাহিনী তারপর পুলিশ লেলিয়ে দিলেন৷
শনিবার সন্ধ্যায় আন্দোলনরত ১০/১২ জন শিক্ষার্থীকে বেধড়ক মারধর করা হয়৷ অভিযোগের তীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের দিকে৷
গত কয়েক বছরে শিক্ষার্থীদের যে কোনো আন্দোলনে এটা নিয়মিত চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ তা সে নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হোক বা কোটা সংস্কার আন্দোলন বা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অশালীন আচরণ বা দুর্নীতির আন্দোলন৷ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে দেওয়ার মোক্ষম অস্ত্রে পরিণত হয়েছে পেটোয়া বাহিনী৷ অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সদস্যরাই এক কাজ করছে৷
শাবিপ্রবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পেটানোর প্রতিবাদে রোববার উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করা হয়৷ তাকে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ বাহিনী৷ শিক্ষার্থীদের দিকে টিয়ার শেল, শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে৷ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তাসহ অর্ধশত আহত হন৷
কার নির্দেশে পুলিশ শিক্ষার্থীদের তাদেরই ক্যাম্পাসে গুলি করার সাহস পেল? প্রশাসন থেকে এমন কোনো নির্দেশ না দেওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে৷ উপাচার্য বলেছেন, পুলিশ বাধ্য হয়ে এ কাজ করেছে৷ তিনি যদি নির্দেশ না দেন তবে পুলিশকে কে বাধ্য করেছে? ওনার বিশ্ববিদ্যালয়ে ওনার শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ গুলি করলে উনি কিভাবে তার দায় এড়াতে পারেন?
শুধু হামলা নয়, পুলিশ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে৷ অভিযোগ, গুলি বর্ষণ এবং হত্যার উদ্দেশ্যে মারপিট৷ আসামি অজ্ঞাতপরিচয়ের ২০০ থেকে ৩০০ জন৷
একজন সাংবাদকর্মী হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলনে এই একই চিত্র দেখছি৷ শিক্ষার্থীরা কোনো কিছুর দাবিতে আন্দোলন শুরু করলেই উপাচার্যের পক্ষে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন পেশীশক্তি ব্যবহার করে তাদের দমাতে চায়৷ তারপর পুলিশি হামলা ও মামলা, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা, হল ছাড়ার নির্দেশ, তদন্ত কমিটি গঠন এসবই চলে৷ তদন্ত চলতেই থাকে, কখনো যদিও বা প্রতিবেদন পাওয়া যায়, তা উপাচার্যের পক্ষেই যায়৷
শাবিপ্রবি-র এবারের ঘটনাটি দেখা যাক৷ একটি হলের ছাত্রীরা হল প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবিতে মূলত আন্দোলন শুরু করেছিল৷ উপাচার্যের সংকট সমাধানের আশ্বাসে তারা হলে ফিরেও গিয়েছিল৷
পরে কর্তৃপক্ষ কী করলেন, ‘বর্তমান প্রভোস্টকে প্রত্যাহার করা হয়নি' বলে তিনি অসুস্থ তাই ছুটি দেখিয়ে একজন ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট নিয়োগ দিলেন৷ ছাত্রীরা বিক্ষুব্ধ হলো, আন্দোলন নতুন মোড় নিলো৷
রোববার পুলিশের হামলার পর রাতে সিন্ডিকেটের জরুরি সভা ডেকে সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলে নতুন প্রভোস্ট নিয়োগ দেওয়া হয়৷ ছাত্রীরা কিন্তু তাদের দাবি অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত নতুন প্রভোস্ট পেল৷ উপাচার্য যদি শিক্ষার্থীদের পুলিশ দিয়ে না পিটিয়ে শুরুতেই এই কাজটি করতেন তবে আন্দোলন সেখানেই থেমে যেত৷ এ যেন সেই প্রবাদের মত ‘সেই তো নথ খসালি, তবে কেনো লোক হাসালি'৷
বাংলাদেশে উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়াটি এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে এখন ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য ছাড়া এই পদে আসীন হওয়া যায় না৷ যারা তাকে নিয়োগ দেন তারা তাকে রক্ষার দায়িত্বও নেন৷ ফলে উপাচার্যরা ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে যান৷
২০১৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাকে অপসারণের দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময়ও একই চিত্র দেখেছি৷ ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ ছিল৷ দুই মাসের বেশি সময় ধরে সেই আন্দোলন চলে৷ আন্দোলন দমনে সেখানেও পেশীশক্তিরই ব্যবহার হয়েছে৷ ক্ষমতাসীন দলকে শিক্ষার্থীদের পক্ষ নয় বরং উপাচার্যের পক্ষ নিতে দেখা গেছে৷ ফারজানা ইসলাম এখনো পদে বহাল আছেন৷
শাবিপ্রবিতেও হয়তো তাই দেখা যাবে৷ বুধবার থেকে সেখানে আমরণ অনশন শুরু করেছেন ২৪ শিক্ষার্থী৷ বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত যে খবর হাতে পেয়েছি, তাদের মধ্যে ১৯ জন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন৷ ছয়জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে৷ বাকি ১৩ জন স্যালাইন নিচ্ছেন৷
এই শিক্ষার্থীদের কেউ যদি মারা যান তার মৃত্যুর দায় কার হবে?