সমস্যার নিগড়ে বাঁধা নারীরা
১৪ ডিসেম্বর ২০১৫সংখ্যার বিচারে এ দূরত্ব ২০০ কিলোমিটারের বেশি হবে না৷ কিন্তু অজপাড়াগাঁয়ের সাধারণ একটি মেয়ের স্বাবলম্বী হওয়ার পথে এই পদক্ষেপ বাংলাদেশে নারীমুক্তির প্রতীক নয় কি? মেয়েটি বঙ্গবন্ধুর কন্যা নন, জিয়া পরিবারের গিন্নী নন, কোনো ধনী, তথাকথিত শিক্ষিত পরিবারে তাঁর জন্মও হয়নি, কিন্তু তারপরও শিল্পীর মতো মেয়েরা যে দূরত্বটা পার হয়েছে, হচ্ছে, তাকে নারীর অগ্রযাত্রা না বললে ইতিহাসকে যে অস্বীকার করা হবে৷ ‘দ্য পাওয়ার টু চুজ' বইটিতেও প্রখ্যাত অধ্যাপক নায়লা কবীর ঠিক সেই কথাই বলেছেন৷ তুলে ধরেছেন তাঁদের কথা, যাঁরা অকল্পনীয় অচলায়তন ভেদ করে এগিয়ে এসেছেন....চোখে স্বপ্ন নিয়ে....নিজের পায়ে তাঁদের যে দাঁড়াতেই হবে...৷
সীমাবদ্ধতার দেয়াল ভেঙে এগিয়ে গেছেন যাঁরা
বাংলাদেশে নারী জাগরণ, নারী আন্দোলনের ইতিহাস অবশ্য নব্বই দশকে পোশাক শিল্প কারখানার বিকাশ থেকে শুরু হয়নি৷ এর বীজ লুকিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক আগে থেকে৷ বাহান্নের ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান আর তারপর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নারীরা ভাষার জন্য, সংস্কৃতির জন্য, দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন৷ আসলে লড়াই-সংগ্রাম, যুদ্ধ-বিগ্রহ, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, শিল্প-সাহিত্য – সর্বত্রই নারী হেঁটেছে পুরুষের সমানতালে৷ বেগম রোকেয়া, লীলা নাগ, প্রীতিলতা, সুফিয়া কামাল, নুরজাহান বেগম, নভেরা আহমদ, তারামন বিবি, ইলা মিত্র, জাহানারা ইমাম অথবা সিতারা বেগম – এরা তো বাংলাদেশেরই মেয়ে ছিলেন৷ কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পরেও নারীকে নারীরূপে দেখার ক্ষেত্রে বড় রকমের কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি৷
নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন অবশ্য বারবারই নারীর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির কথা বলেছেন৷ তিনি মনে করেন, ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের পথে সহায়ক হয়েছে৷ তা সত্ত্বেও নারীর প্রতি নির্যাতনের হার তেমন কমেনি৷ এই অগ্রগতি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায়, আয়ে, এমনকি স্বাস্থ্যখাতে দৃশ্যমান হলেও, নারীর প্রতি বৈষম্য আজও দূর হয়নি বাংলাদেশে৷ তবে এতেও দমে যায়নি নারী৷
বরং লড়াইটা চলছে, নানা মাত্রায়, নানা ক্ষেত্রে
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকারও নারী৷ এছাড়া এই গত ২৫ বছরে আমরা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সালমা খাতুনকে যেমন পেয়েছি, পেয়েছি এভারেস্ট জয়ী নিশাত মজুমদার, আলোকচিত্রী সাঈদা খানম অথবা ক্যাপ্টেন জান্নাতুল ফেরদৌসের মতো সাহসী নারীকেও৷ তাই মেধায়, মননে, শ্রমে, চর্চায়, দায়িত্বে, কর্তব্যে নারীর পদচারণ যে পুরুষের সমকক্ষ হয়েছে, সেটা ভুলে গেলে আমাদের একেবারেই চলবে না৷
এই তো কয়েক মাস আগের কথা৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছিলেন, বাংলাদেশে নাকি নারীদের জাগরণ এসেছে৷ তাঁর কথায়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এ দেশের নারীদের সব পেশার দরজা খুলে দিয়েছেন৷ আজ মেয়েরা সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন৷ এমনকি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতেও কাজ করছেন বাংলাদেশের নারীরা৷ মন্ত্রীর কথায়, ‘‘কাজ করলে সমস্যা আসবে৷ তাই পিছিয়ে গেলে চলবে না৷ সমস্যা মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হবে৷'' আর ঠিক সেটাই তো প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত করে চলেছেন শিল্পীর মতো মেয়েরা৷ তাই না?
আরো হাজারো শিল্পী লুকিয়ে আছে ঢাকা শহরে
শিল্পীর মতোই আরো অজস্র নারী কাজ করছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানায়৷ কিশোরী ও মাঝবয়সি এ সব নারীরা মফঃস্বল এবং প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসে যোগ দিয়েছে, দিচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্পে৷ কিশোরগঞ্জের সখিনা, নীলগঞ্জের সমলা, বাসিরন ও ঝুমা আর বরিশালের তসলিমা গার্মেন্টসের কারখানায় নাম লেখানো তালিকারই কয়েকটি নাম৷ গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দিয়েছে এরা৷ এদের কেউ ঢাকায়, কেউ গাজীপুর, আবার কেউ স্থায়ী হয়েছে নারায়ণগঞ্জের কারখানায়৷
বলা বাহুল্য, আজ বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস তৈরি পোশাক শিল্প৷ প্রতিবছর বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৭০ ভাগেরও বেশি এ খাত থেকেই আয় হয়৷ বাংলাদেশের প্রায় ৫ হাজার গার্মেন্টস বা তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করছে অন্তত ৪৫ লাখ শ্রমিক৷ আর এই বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের মোট আশি ভাগই নারী কর্মী৷ বাংলাদেশের মতো ছোট্ট একটা দেশের জন্য এ একটা বিরাট প্রাপ্তি, অর্জন নয় কি? শিল্পীর মতো এ সব মেয়েরা সমাজ-সংস্কার-সংসার সামলে যেভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, স্বামী বা বাবার দুস্থ সংসারের হাল ধরছেন অথবা স্বপ্ন দেখছেন কোলের ছেলেটার জন্য একটা সুন্দর ভবিষ্যতের, তাঁদের কি আপনি নারীর অগ্রযাত্রার প্রতীক বলবেন না?
আমি তো বলবো৷ একটা সময় ছিল, যখন দরিদ্র পরিবারের অনেক মেয়েই বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ করতো৷ কিন্তু গার্মেন্টস কারখানাগুলো নারীকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছে৷ যে মেয়ে একদিন সংসারে বোঝা ছিল, আজ সে-ই পারিবারিক আয়ের একটা বড় উৎস৷ দেশের অর্থনীতিতে এর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে, ক্ষমতায়ন হয়েছে নারীর৷ তবে ন্যূনতম মজুরি বাড়লেও আজও শিল্পীদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়৷ এদের সকলকে মাথা গোঁজার একটা ঠিকঠাক ঠাঁই, এমনকি বিশুদ্ধ খাবার পানির নিশ্চয়তাও আমরা দিতে পারিনি৷ তাজরীন আর রানা প্লাজার ভয়াবহ ঘটনার পরেও দিতে পারিনি পর্যাপ্ত সুরক্ষা...৷
এই গার্মেন্টস কর্মীদের মতো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব প্রান্তিক মানুষের প্রতিবাদী-প্রগতিসূচক আন্দোলন আমাকে আন্দোলিত করে৷ তাই কণ্ঠ সোচ্চার করে, নাটক করে, লিখে, তাঁদের এই আন্দোলনে শরিক থাকার চেষ্টা করি৷ আর যতবারই সেটা করি, অবাক হই গ্রামবাংলার এই সাধারণ মেয়েদের মনের জোর, অক্লান্ত পরিশ্রম আর সরলতা দেখে৷ মনে পড়ে যায় নারীর ক্ষমতায়নের অনেকটা পথ এখনও পার হতে হবে৷ মনে মনে বলি, নারী-শ্রমিকের জীবন আজও কিন্তু সমস্যার নিগড়ে বাঁধা...৷
বন্ধুরা, শিল্পীরা কি সত্যিই নারীর অগ্রযাত্রার প্রতীক নয়? জানান আপনার মন্তব্য, নীচের ঘরে৷