মালিকরা স্বাধীন, সাংবাদিকরা নয়
২৮ জুন ২০১৬‘‘সে কারণে বর্তমান সরকারের দেয়া স্বাধীনতা কোনো কাজেই আসছে না৷'' – ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে এমনই অভিমত দিয়েছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক৷ তাঁর মতে, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা দরকার৷ শ্রমিকদের থেকে সাংবাদিকদের পৃথক করা দরকার৷
বাংলাদেশে ক্রমাবনতিশীল স্বাধীন মতামত প্রকাশ আর এই অধিকার নিশ্চিত করতে বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কর্মরত প্রভাবশালী ১৯টি আন্তর্জাতিক সংগঠন সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রতি আহবান জানিয়েছে৷ এ সব সংগঠনগুলোর মধ্যে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে), পেন অ্যামেরিকা ও রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারর্সের মতো সংগঠনও রয়েছে৷ সম্প্রতি জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের অধিবেশনে ঐ সংগঠনগুলো যৌথভাবে এক লিখিত আবেদন দিয়েছে বলে জানা গেছে৷
সংগঠনগুলো লিখিত আবেদনে বলেছে, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে একের পর এক ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একজনকেও বিচারের মুখোমুখি না করার ব্যর্থতায় বাংলাদেশে ভীতির এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে৷ মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোর সাংবাদিকরা জেল এবং আইনি হুমকি-ধামকিসহ নানা চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করছে৷
এ বিষয়ে জাতীয় প্রেসকাবের নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য ও ইত্তেফাকের কূটনৈতিক সম্পাদক মাঈনুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম স্বাধীন৷ তবে এই স্বাধীনতায় কিছুটা ঘাটতি আছে, আছে কমতি৷ তবে কতটুকু স্বাধীন সেটা নির্ণয়ের ব্যাপার, পর্যবেক্ষণের ব্যাপার৷ এখানে আরো করণীয় আছে, পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপার আছে৷ এখন বাংলাদেশের সাংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যদি পাশ্ববর্তী দেশ ভারত বা ইউরোপ অথবা যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমের তুলনা করা হয়, তাহলে অতৃপ্তিবোধটা থেকেই যাবে৷ অবশ্য এর মানে এই যে, এখানে উন্নতির জায়গা আছে৷''
বাংলাদেশের সাংবাদিকরা কতটা স্বাধীন? এমন প্রশ্নের জবাবে মাঈনুল আলম বলেন, ‘‘এই স্বাধীনতার সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তার ব্যাপার আছে, আমাদের প্রাপ্তির বিষয় আছে৷ আমাদের চিন্তা প্রকাশের সঙ্গে এটা সম্পর্কযুক্ত৷ হ্যাঁ, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের রাষ্ট্রীয় কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই৷ তবে অন্য একটি নিয়ন্ত্রণ আছে৷ আর সেটা হলো সংবাদমাধ্যমের মালিক বা উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণ৷ তবে সম্প্রতি সংসদে তথ্যমন্ত্রী যে তথ্য দিয়েছেন, সেটা নিয়ে নতুন করে ভাবনার বিষয় রয়েছে৷ বাংলাদেশের ৭২ শতাংশ সংবাদমাধ্যমের মালিকপক্ষই সম্পাদক বা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন৷ এটা আমাকে চিন্তিত করেছে৷ আমরা কোন পরিস্থিতির দিকে অগ্রসর হচ্ছি!''
গত ফেব্রুয়ারিতেই সংবাদমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক নানা পদক্ষেপে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল সম্পাদক পরিষদ৷ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজ আনাম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তখন বলা হয়েছিল, ‘‘আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্র ও জাতীয় প্রচারমাধ্যমের পক্ষে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ছে৷ একদিকে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে দায়িত্বরত সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, অন্যদিকে সংবাদপত্র ও প্রচারমাধ্যমের স্বধীনতা খর্ব করার চেষ্টা চলছে৷ সরকারের পক্ষ থেকে প্রচারমাধ্যমের অধিকারে অযাচিত হস্তক্ষেপ করাও হচ্ছে৷''
পাশাপাশি সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা তো রয়েছেই৷ গত বছর বাকস্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন আর্টিকেল-১৯ সাংবাদিক নির্যাতন নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ এতে বলা হয়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে সাংবাদিক নির্যাতনের হার ছিল ১২ দশমিক ৫ শতাংশ৷ এক বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে এই হার হয়েছে ৩৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ৷ এর প্রায় ২৩ শতাংশ নির্যাতনই ঘটেছে পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের হাতে৷ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাইরে সরকারি কর্মকর্তাদের হাতে ১১ শতাংশ হামলার ঘটনা ঘটেছে৷ ২০১৪ সালে রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ৬৬ দশমিক ৩১ শতাংস৷ এর মধ্যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হাতে ৩৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ ঘটনা ঘটেছে৷ ২০১৪ সালে ২১৩ জন সাংবাদিক ও আটজন ব্লগার বিভিন্নভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছেন৷ এর মধ্যে অন্তত চারজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হন৷
সাংবাদিক নেতা ওমর ফারুক বলেন, ‘‘সাংবাদিকদের স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়াই করে যাচ্ছি৷ আসলে সরকারের সহযোগিতা না পেলে আমরা সফল হতে পারব না৷ ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু নিউজ পেপার সার্ভিসেস অ্যাক্ট করেছিলেন৷ সেই আইনের আওতায় আমরা অনেকরকম স্বাধীনতা ভোগ করেছি৷ কিন্তু ২০০৬ সালে খালেদা জিয়া সরকার সেই আইনটি বাতিল করে কুলি-মজুরের যে অধিকার, সেই অধিকারের মধ্যে আমাদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন৷ যে কারণে সাংবাদিক হিসেবে আমাদের যে স্বাধীনতা, সেটা আমরা ভোগ করতে পারছি না৷ এখন সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া, সেই আইনটি পূনর্বহাল করা এবং সেটিকে যুগোপযোগী করা৷''
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷