কিন্তু কলকাতায় যতদিন ছিলাম, ততদিন দেখেছি, ফুটপাত হলো ছোট দোকানদারদের জন্য৷ তারা সেখানে হরেকরকম পশরা সাজিয়ে বসবেন৷ আর ক্রেতারা সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কেনাকাটা করবেন৷ এককথায় ফুটপাথ ইজ ইকুয়াল টু বাজার৷ তাহলে হাঁটার অধিকার? তার জন্য রাস্তা আছে৷ রাস্তায় হাঁটলে গাড়িওয়ালাদের ধাক্কা মারার অধিকার আছে৷ তাতে আপনি মারা গালেই বা কী আসে যায়! সারা বিশ্বে সবচেয়ে সস্তা জিনিস তো মানুষের প্রাণই৷
বরাবর দেখে আসছি, অধিকার বড় গোলমেলে বিষয়৷ কোথায় যে কার অধিকারের শুরু, কার শেষ সেই হিসাব এখনও কিছুতেই মেলাতে পারলাম না৷ একেবারে সেই তৈলাক্ত বাঁশে বান্দরের ওপরে ওঠার অঙ্কের মতো৷ তিন পা ওঠে, দুই পা পিছলে যায়৷ এভাবে শেষ পর্যন্ত বাঁশের ডগায় সে কতক্ষণে পৌঁছাবে? বান্দর একটা তৈলাক্ত বাঁশে কেন চড়তে যাবে, চড়লেই বা সে কতক্ষণে ওপরে পৌঁছাবে তা আমি কেন হিসাব করতে বসব, এসব প্রশ্নের কোনো জবাব কিছুতেই পাওয়া যায় না৷ অধিকারের গল্পটাও সেরকমই গোলমেলে৷
কলকাতার ফুটপাত হলো দোকানদার ও ক্রেতাদের অধিকার, দিল্লি এসে দেখলাম ফুটপাত হলো গাড়িমালিকদের পার্কিং করার অধিকারক্ষেত্র৷ রাজধানীর যে কোনো মহল্লায় চলে যান, দেখবেন সুদৃশ্য ফুটপাত রয়েছে, আর সেই ফুটপাত দখল করে রেখেছে গাড়ি ও বাইক৷ বাড়ির মালিক, দোকানদার, বাইরের মানুষের গাড়ি৷ ফুটপাথে গাড়ি রেখে তারা অসীম আনন্দ লাভ করেন৷ হবে নাই বা কেন, দিল্লির গাড়ি ও বাইকের সংখ্যা জানেন? ২০২০-২১-এর হিসাব, দিল্লিতে সবমিলিয়ে এক কোটি ২২ লাখেরও বেশি গাড়ি, বাইক, অটো আছে৷ তার মধ্যে বাইক আছে ৮২ লাখ ৩৯ হাজার এবং গাড়ির সংখ্যা ৩৩ লাখ ৮৪ হাজারেরও বেশি৷ দিল্লির মানুষের বাইক ও গাড়ি কেনার অধিকার আছে৷ গাড়ি বা বাইক থাকলে তা রাখার অধিকার আছে৷ ফুটপাতটাকে পার্কিং প্লেস বানাবার অধিকারও নিশ্চয়ই আছে৷ না হলে দিল্লি জুড়ে কেন ফুটপাতে গাড়ি রাখা হয়? দিল্লিতে পার্কিং নিয়ে ঝগড়া, মারামারি তো নিত্যদিনের ঘটনা!
পার্কিং সমস্যা মেটানোর জন্য দিল্লিতে নিয়ম করা হয়েছে, তিন-চার তলা বাড়ি হলেও নিচের তলাটা রাখা থাকবে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য৷ সেভাবেই এখন বাড়ি বানানো হচ্ছে৷ কিন্তু তারপর নীচের তলাটা ফাঁকা রেখে বাড়ির মানুষ রাস্তায় গাড়ি রাখছেন? কেন রাখছেন, এই প্রশ্নের জবাব বান্দরের ওই তৈলাক্ত বাঁশে ওঠার অঙ্কের মতোই জটিল৷ অধিকার, অধিকার সচেতনতা, অধিকারহীনতা নিয়ে কম আলোচনা তো হলো না৷ কিন্তু তাতে মানুষের চৈতন্য হলো কি?
কোথায় আর হয়! কয়েকদিন আগে সরিস্কায় একটি রিসোর্টে গিয়েছিলাম৷ দূরে ছোট-বড় টিলা৷ বড় মাঠ, অঢেল গাছ, কিছুটা দূরে টাইগার সাফারির জঙ্গল, আর রিসর্টে আমলকি বনের মধ্যে গোটা ছয়েক সুইস টেন্ট৷ আমার পাশের টেন্টে কয়েকজন যুবক ফুল ভলিউমে সাউন্ড বক্স চালু করে দিলেন৷ বারবার রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের কাছে কমপ্লেন করা হলো এবং তাদের কর্মীদের একাধিকবার অনুরোধ সত্ত্বেও আওয়াজ আর কমে না৷ একটু কম করলে আবার ১০ মিনিট পরে বাড়িয়ে দেয়৷ শেষপর্যন্ত পুলিশে নালিশ করার হুমকি দিয়ে তা কম করাতে পেরেছিলাম৷ ওই যুবকদের তারস্বরে গান শোনার অধিকার আর আমার সেই গান না শোনার অধিকার নিয়ে স্পষ্ট আইন আছে৷ আমার অধিকার অন্য কারো অধিকারে যেন হস্তক্ষেপ না করে৷ তার বিরক্তির কারণ না হয়৷ আছে তো সবই৷ ভারতের অতবড় সংবিধানে, লম্বা-চওড়া দণ্ডবিধিতে কি কম কথা লেখা আছে? প্রশ্ন হলো, সেই সব জানে কে, মানেই বা কে? যার যখন ইচ্ছে, সে তখনই অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে৷ সিংহভাগ মানুষ তো জানেই না তাদের কী অধিকার আছে৷
ভারতে যে খাদ্যের অধিকার আছে, তা কত শতাংশ মানুষ জানে? ২০১৩ সালে সংসদে খাদ্যসুরক্ষা আইন পাস হয়েছে৷ এই আইন অনুসারে শহরের গরিব, যাদের সংখ্যা ৫০ শতাংশ এবং গ্রামের গরিব, যাদের সংখ্যা ৭৫ শতাংশ, তাদের দুই টাকা, তিন টাকায় খাদ্যশস্য দিতে সরকার বাধ্য৷ এটা গরিব মানুষের আইনি অধিকার৷ তার উপর মানবাধিকার কমিশনও ঘোষণা করেছে, খাদ্যের অধিকার হলো মৌলিক অধিকার৷ ফলে শহর ও গ্রামের গরিবরা যে কম দামে রেশন পান, সেটা তাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে, এটা সরকারি দাক্ষিণ্য নয়, এই বোধটাই মানুষের নেই৷ কারণ, তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে জানেনই না৷
এই প্রসঙ্গে একটা অসাধারণ কথা বলেছিলেন কেরালার ট্যাক্সিচালক৷ তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কেরলে রেশন ব্যবস্থা এত ভালো হলো কী করে? আর অধিকাংশ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি প্রকল্প সম্পর্কে মানুষ এত ওয়াকিবহাল কী করে? সফর বলেছিলেন, এর একটা কারণ, কেরলে প্রায় একশ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত ও মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরাজি পড়তে ও বলতে পারেন৷ তাই তারা জানতে পারেন তাদের কী অধিকার আছে৷ দ্বিতীয়ত, কেরালায় দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মনে একটা সংস্কৃতি ঢুকে গেছে৷ তা হলো, নিজেদের অধিকারগুলো সম্পর্কে জানার সংস্কৃতি৷ কিন্তু এই সংস্কৃতি ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে দেখিনি৷
ভারতের কতজন মানুষ জানেন এলিপিজি সিলিন্ডার ফেটে বাড়ির ক্ষতি হলে, কেউ মারা গেলে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত তারা ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন৷ এরকম ঘটনা ঘটলে উল্টে পুলিশ এসে তাদের ধরে, বলে, তাদের অবহেলার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে৷ নারীরা কি জানেন, কোনো পুরুষ পুলিশ অফিসার তাদের থানায় নিয়ে যেতে পারে না৷ একমাত্র নারী পুলিশ অফিসাররাই তাদের থানায় নিয়ে যেতে পারেন৷ সেটাও সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে৷ আমরা হামেশাই দেখি, নারীরা আন্দোলন করতে রাস্তায় নেমেছেন, বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, পুরুষ পুলিশ কর্মীরা তাদের ধরছেন, গ্রেপ্তার করে বাসে বা পুলিশের গাড়িতে তুলে দিচ্ছেন৷ ওই নারীরাও প্রশ্ন তোলেন না৷ তুললেও পুলিশ শোনে না৷
অধিকার সচেতনতা না থাকার সবচেয়ে বড় উদাহরণ তো এমআরপি বা ম্যাক্সিমাম রিটেল প্রাইসের বিষয়টি৷ ভারতে আইন হলো, এমআরপি যা লেখা থাকে, তার থেকে বেশি দাম নেয়া যায় না৷ নিলে ক্রেতারা কনজিউমার কোর্টে যেতে পারেন৷ তাহলে বিক্রেতার ক্ষতিপূরণ দেয়া প্রায় নিশ্চিত৷ কিন্তু অনেক হোটেল-রেস্তোরাঁয় এমআরপি-র থেকে বেশি দাম নেয়া হয়৷ কেউ নালিশও করে না৷ অধিকাংশ মানুষ জানেও না তাদের অধিকারের পরিধি৷
অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে মানুষ কতটা সচেতন তা নিয়ে একটা সমীক্ষা হয়েছিল৷ তাতে দেখা গেছে, অর্ধেক ভারতবাসীর এই বিষয়ে কোনো চেতনাই নেই৷
সম্প্রতি কাজের সূত্রে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে যেতে হয়েছিল৷ সেখানেই বাজার কমিটির সম্পাদক ফারুখ সর্দার একটা প্রশ্ন করেছিলেন৷ বলেছিলেন, ‘‘আমরা তো স্বাধীন দেশের নাগরিক, আমাদের লাইসেন্স থাকা সত্ত্বেও কেন স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে পারব না৷ কেন প্রতিবার গ্রামে যেতে আসতে কার্ড দেখাতে হবে, জবাবদিহি করতে হবে? এই যন্ত্রণা কেন সহ্য করতে হবে৷ যদি চোরাচালান হয়, সেটা থামানো তো নিরাপত্তারক্ষীদের কাজ৷ তার জন্য আমাদের অধিকারহরণ কেন করা হবে?''
আগেই বলছিলাম না অধিকার, তা নিয়ে সচেতনতা, তার সীমা বড়ই গোলমেলে বিষয়৷ সেই হীরক রাজার দেশের মতো, যে যত পড়ে, সে তত শেখে, তত প্রশ্ন করে৷ সেসব হলেই তো মুশকিল৷ সরকার, জনপ্রতিনিধি, আশপাশের মানুষকে তার জবাব দিতে হবে, মানুষকে অধিকার দিতে হবে৷ তার থেকে ওসব খাতায়-কলমেই থাক৷ মানুষের সচেতনতা না থাকলেই বা কী হয়েছে, অধিকার তো আছে৷