সন্ত্রাস সংঘর্ষের আশঙ্কা ও আসন্ন নির্বাচন
১৩ নভেম্বর ২০১৮এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে হত্যা করেছে, বিষয়টি তেমন নয়৷ দুই গ্রুপের ধাওয়া-পালটা ধাওয়ায় গাড়ির নীচে পড়ে দু'জন নিহত হয়েছেন৷
এবারের জাতীয় নির্বাচনে অন্যান্যবারের চেয়ে ভিন্ন রকমের সাংঘর্ষিক অবস্থা দৃশ্যমান হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন৷ অন্য দলের চেয়ে নিজ দলের ভেতরে গ্রুপে-গ্রুপে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷ এবং সেটা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভেতরে বেশি দৃশ্যমান হতে পারে৷ কম হলেও সেটার সম্ভাবনা থাকছে বিএনপির ভেতরেও৷ নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে খুব বেশি সময় নেই৷ কীভাবে তারা প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন, সেটা একটি বিষয়৷ তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি কতটা জটিল আকার ধারণ করতে পারে এবং তা মোকাবিলার প্রস্তুতি দলগুলোর কতটা আছে? নির্বাচন কমিশন কথা বলা ছাড়া আর কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে কি?
সংক্ষেপে কিছু কথা
১. আপনি যে কোনো একটি জেলা শহরে যান৷ দেখবেন, সেই শহরে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের যত নেতা আছেন তাঁরা প্রায় সবাই এবারের জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান৷ তাঁদের পোস্টার-দেওয়াল লিখনে শহর ছেয়ে গেছে৷ অন্যান্যবার কি এমন দৃশ্য চোখে পড়ত না? না, এতটা চোখে পড়ত না৷ আগে একেকটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী থাকতেন দু'জন থেকে চার বা পাঁচজন৷ এবার সংখ্যা অগণিত৷ তারপর আবার জোট শরিক অন্যান্য দলের ছোট-বড় নেতাও আছেন৷
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রেক্ষিতে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে৷ ১৫৪ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং অন্যরাও ভোটারের ভোট ছাড়া নির্বাচিত হয়েছেন৷ আওয়ামী লীগের নেতাদের ধারণা হয়েছে, এবারের নির্বাচন হুবহু তেমন না হলেও বিজয়ী তাঁরাই হবেন৷ মনোনয়ন কে পেলেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করায় প্রশাসনিক সহায়তায় বিজয়ী আওয়ামী লীগ বা তাদের জোট প্রার্থীই হবেন৷ ধারণাটা এমন যে, মনোনয়ন পাওয়া মানেই এমপি নির্বাচিত হয়ে যাওয়া৷ ফলে সকল নেতাই নিজেকে প্রার্থী হিসেবে ভাবছেন৷ সবাই যাঁর যাঁর মতো করে কর্মী-ক্যাডার নিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছেন৷ কেউ কাউকে মানছেন না৷ ‘চেইন অফ কমান্ড' নেই বা থাকবে না৷ মনোনয়ন পাওয়ার আগে থেকে নিজেরা নিজেরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে পারেন৷ দলীয় মনোনয়ন যেহেতু একজন পাবেন, অনেকে স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে চাইবেন৷ নিজ দলের মধ্যে একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কর্মী-ক্যাডার-সমর্থকরা সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি করতে পারেন৷
২. ক্ষমতায় থেকে গড়ে-বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল বিএনপি প্রায় এক যুগ ক্ষমতার বাইরে৷ সরকারি দমনপীড়নে পিষ্ঠ৷ খালেদা জিয়া জেলে, তারেক জিয়া বিদেশে৷ জনশ্রুতি, আপোশ ফর্মুলায় রাজি না হওয়ায় খালেদা জিয়ার আশু কারামুক্তির সম্ভাবনা নেই৷
তা সত্ত্বেও টানা দশ বছর ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় নির্বাচনে বিজয়ের জোরালো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বিএনপির৷ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে মাঠে নামায় নেতাকর্মীরা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠছেন৷ যদি মানুষ ভোট দিতে পারেন, নির্বাচন যদি মোটামুটি সুষ্ঠুও হয়, বিএনপি নেতারা মনে করছেন তাদের বিজয় ঠেকানো যাবে না৷ নেতারা মনে করছেন, কে প্রার্থী তা গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ ধানের শীষ নিয়ে যিনি নির্বাচন করবেন, তিনিই বিজয়ী হবেন৷ ফলে বিএনপিরও প্রায় সব নেতাই নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাইছেন৷ বিএনপির ভেতরেও দল উপদল, পক্ষ প্রতিপক্ষ তৈরি হতে পারে৷ নিজেরা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে পারেন৷ জোটের নেতা ও জামায়াতকে আসন ছাড়ার কারণে সংকট আরও জোরালো হয়ে উঠতে পারে৷
৩. নির্বাচনের মাঠ সমতল হবে, সেই সম্ভাবনা খুবই কম৷ প্রশাসন সরকারের অনুকূলেই থাকবে৷ দূর্বল নির্বাচন কমিশন সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বলে মনে হয় না৷ বিগত ইউপি নির্বাচনে শতাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল৷ সন্ত্রাস-হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল উপজেলা নির্বাচনেও৷ নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি৷ বিগত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলোতে প্রাণহানির সংখ্যা বেশি না হলেও, পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে পারেনি নির্বাচন কমিশন৷ ভোটকেন্দ্র দখল হয়ে গেছে, মানুষ ভোট দিতে পারেনি৷ তারওপর মোহাম্মদপুরের দু'জন নিহত হওয়ার ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের সচিবের প্রতিক্রিয়া ‘জানা নেই’৷ এই অবস্থান নতুন আশঙ্কা তৈরি করছে৷ সরকারি দলের ভেতরের সংষর্ষ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে যদি ‘জানা নেই’ নীতি নেয় নির্বাচন কমিশন, তবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠতে পারে৷
এমপি পদে বহাল থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নির্বাচন করবেন, অন্যদিকে এতদিন নির্যাতত হয়ে মাঠে নামবেন বিএনপি নেতা-কর্মীরা৷ সাংঘর্ষিক একটা অবস্থা তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়৷
সেই পরিস্থিতির মাঝে রেফারির ভূমিকায় থাকা নির্বাচন কমিশন শক্ত অবস্থান নেবে কিনা, নির্বিকার থেকে নিরপেক্ষতার পরিবর্তে পক্ষাবলম্বন করবে কিনা, তার উপর নির্বাচনি পরিবেশের অনেক কিছু নির্ভর করছে৷ মানুষ তার ভোট দিতে পারবে, নির্বাচন কমিশন যদি তেমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে পারে, সন্ত্রাস সংঘর্ষের সম্ভাবনা কমে যাবে৷ সেক্ষেত্রে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের বিষয়েও কঠোর হতে হবে নির্বাচন কমিশনকে৷ সরকারের সঙ্গে তখন আর হৃদ্যতা থাকবে না৷
নির্বাচন কমিশন তা করার চেষ্টা করবে কিনা, সেই চেষ্টা দৃশ্যমান হবে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন৷
এবারের নির্বাচনে ২০১৪ সালের পেট্রোল বোমা, সড়ক-গাছ কাটা সন্ত্রাস ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নির্বিচার গুলি বর্ষণের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে৷
তবে ভিন্ন রকমের সন্ত্রাস-সংঘর্ষ-প্রাণহানির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷