বন্ধুটি স্ত্রী সন্তানসহ ঢাকায় থাকেন৷ বন্ধুর চাকরি ঢাকার বাইরে৷ বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে বাসায় পৌঁছায় রাতে৷ তারপর আবার শনিবার সকালে চাকরিস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে দুপুরে পৌঁছায় সেখানে৷ এরপর বিকাল থেকে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে রোগী দেখা শুরু করে৷ চলে রাত ১১টা-সাড়ে ১১টা পর্যন্ত৷ এভাবে শনিবার থেকে শুরু করে বুধবার পর্যন্ত প্রতিদিন অত রাত পর্যন্ত রোগী দেখে সে৷ আর দিনের বেলায় সরকারি হাসপাতালে রোগী দেখার কাজতো আছেই৷ সরকারি চাকরিতে ঢোকা অধিকাংশ তরুণ চিকিৎসকের রুটিনই মোটামুটি এই রকম৷
এবার পুরো ঘটনাটা আরেকবার ভেবে বলনুতো একজন মানুষ (ডাক্তার হলেও মানুষতো) যদি এত পরিশ্রম করেন, তাহলে তার পক্ষে সবসময় মাথা ঠান্ডা রেখে ভাল চিকিৎসা দেয়া সম্ভব কিনা৷ রোগীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা সম্ভব কিনা৷ আমার বন্ধুতো অবলীলায় স্বীকার করেই বলেছে যে, না সম্ভব নয়৷ অথচ আমরা অনেকেই মানি, রোগীর রোগ অর্ধেক ভালো হয়ে যায় ডাক্তারের ভালো ব্যবহারে৷ কিন্তু বাংলাদেশে আমরা সেটা পাচ্ছি কোথায়?
এরপর আসি ডাক্তার-রোগীর কথোপকথনে৷ রোগভেদে কোনো কোনো রোগীর সঙ্গে ডাক্তারের একটু বেশি সময় দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে৷ কিন্তু অনেক চিকিৎসকই সেই সময়টা দিতে চান না৷ সরকারি হাসপাতালে থাকলে অত্যধিক রোগীর চাপে আর ক্লিনিকে থাকলে অল্প সময়ে বেশি রোগী দেখে বেশি অর্থ আয়ের লোভে এমনটা করে থাকেন তাঁরা৷ ফলে একজন রোগীকে তাঁর রোগ সম্পর্কে ডাক্তার যা বলেন, শুধু তা শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়৷
ধরলাম, অনেক ডাক্তার আছেন যাঁরা রোগীদের সুচিকিৎসা দিতে চান৷ কিন্তু তার জন্য যে অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, ওষুধ ইত্যাদি দরকার তার অভাব আছে সরকারি হাসপাতালগুলোতে৷ অনেক ক্ষেত্রে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা দেয়ার জন্য যে উপকরণ প্রয়োজন তা-ও পাওয়া যায় না৷ জরুরি রোগীকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে অ্যাম্বুলেন্স দরকার তা-ও পর্যাপ্ত নেই৷ আবার থাকলেও দেখা যায়, হাসপাতালের ডাক্তাররা অনেকসময় ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সেই অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করছেন৷ রাজনৈতিক প্রয়োজনেও কখনো কখনো অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবহার অতীতে দেখা গেছে৷
চেনাশোনা থাকতে হবে
বাংলাদেশে এটি সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য৷ ভালো চিকিৎসা পেতেও এটি দরকার৷ আপনি নিজে কতটা পরিচিত বা অর্থবিত্তের মালিক, কিংবা আপনার পরিচিতজন কতটা ‘শক্তিশালী', তার উপর নির্ভর করে আপনি কেমন ডাক্তার আর কেমন চিকিৎসা পাবেন৷ আপনি যদি একেবারেই সাধারণ কেউ হন তাহলে মোটামুটি ধরেই নিতে হবে যে, আপনি সুচিকিৎসা পাবেন না৷ আর যদি পান তাহলে তা আপনার সৌভাগ্য বলতে হবে৷
বেসরকারি চিকিৎসার হাল
সরকারি হাসপাতালগুলোর করুন অবস্থার সুযোগে দেশে অনেক বেসরকারি উদ্যোগে ক্লিনিক ও হাসপাতাল গড়ে উঠেছে৷ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সবশেষ তথ্য বলছে, দেশে সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৫৯২টি৷ আর বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার৷ কিন্তু চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি হওয়ায় দরিদ্রদের পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব হয় না৷ তবে অনেক টাকা নিলেও যে বেসরকারি হাসপাতালে সবসময় ভালো চিকিৎসা পাওয়া যায়, তা নয়৷ ভালো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকায় তারা রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য ইচ্ছেমতো টাকা নিয়ে থাকে৷ এছাড়া অযথা নানান পরীক্ষা করিয়ে (যেহেতু পরীক্ষাটা আসলেই প্রয়োজন কিনা তা সাধারণের পক্ষে জানা সম্ভব নয়) টাকা নেয়া, এমনকি রোগী মারা যাওয়ার পরও হাসপাতালে রেখে দিয়ে বাড়তি অর্থ আদায়ের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে৷ আছে মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহারসহ অন্যান্য অভিযোগও৷
কী করণীয়
আসলে সমস্যার কথা বেশি বলার প্রয়োজন নেই৷ কারণ বাংলাদেশে বসবাসরত প্রায় সবারই চিকিৎসা নিতে গিয়ে কমবেশি ভোগান্তিতে পড়ার অভিজ্ঞতা আছে৷ তাই সমাধান কী হতে পারে তা নিয়ে ভাবতে হবে৷
কিছু প্রস্তাব:
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নাগরিকদের ভালো চিকিৎসা সেবা দিতে চাইলে এই খাতে জিডিপির শতকরা পাঁচ ভাগ অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে৷ বাংলাদেশ সেখানে দিচ্ছে মাত্র এক শতাংশ৷ সুতরাং বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং টাকাটা যেন সঠিক জায়গায় কাজে লাগানো হয় (যেমন সরকারি হাসপাতালের প্রসার ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো, আরও চিকিৎসক নিয়োগ ইত্যাদি) সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে৷
- সবার জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালু করতে হবে৷ সামর্থ্যবানরা তাদের বিমার প্রিমিয়াম নিজেরা দেবে আর সরকার দেবে দরিদ্রদেরটা৷ ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে টাঙ্গাইলের তিনটি উপজেলায় স্বাস্থ্যবিমার মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে৷ শিগগিরই দেশের সবাইকে এই সেবার আওতায় আনতে হবে৷ প্রয়োজনে এক্ষেত্রে ফিলিপাইনের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়া যেতে পারে৷ তাহলে ধনী-গরিব সবাই চিকিৎসা সেবার আওতায় আসবে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷