ভারতে গড়ে উঠবে সাতরঙা সমাজ?
৩১ আগস্ট ২০১৭যৌন পছন্দ বেছে নেওয়ার দাবিতে লড়াই, অধিকার-আন্দোলন দীর্ঘ দিনের৷ বিশ্বের বহু উন্নত দেশ স্বীকৃতি দিলেও ভারতে এখনও সমকামিতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ তবে এবার আশা, সমকামের ছাড়পত্র মিলবে৷ দিল্লি হাইকোর্ট ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারাকে অপরাধের শ্রেণি থেকে বাইরে রাখলেও, সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে রয়েছে মামলা৷ পরিস্থিতি অবশ্য ক্রমেই বদলাচ্ছে৷ একের পর এক ঐতিহাসিক রায় দিয়ে বিচার ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা অটুট রাখতে সক্ষম হয়েছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত৷ এই তো ক'দিন আগেই ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিতে গিয়ে ব্যক্তির যৌন পছন্দকেও মৌলিক অধিকার হিসেবে মেনে নিয়েছে শীর্ষ আদালত৷ উল্লেখ করা হয়েছে, সংবিধানের ১৪, ১৫ ও ২১ নং অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারের বিষয়টি৷ আধার কার্ডে ব্যবহৃত ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ্যে আসার বৈধতা-সংক্রান্ত একটি মামলায় রায় ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্ট৷ গোপনীয়তাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে৷ ঐ রায়ে বলা হয়েছে, ‘‘জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে পৃথক করা যায় না৷ সমতা, স্বাধীনতা ও বেঁচে থাকার অধিকারের সমান এটি৷ এলজিবিটি সম্প্রদায় যৌন সংখ্যালঘু হতে পারেন, কিন্তু সেই যুক্তিতে তাঁদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়৷'' যদিও এলজিবিটি ( লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়্যাল এবং ট্রান্সজেন্ডার) বিষয়ক মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের অন্য একটি বৃহত্তর বেঞ্চে শুনানি চলছে৷ সেক্ষেত্রে এ বিষয়ে চূড়ান্ত রায়দান করবে সংশ্লিষ্ট বৃহত্তর বেঞ্চটি৷
সদ্য প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জগদীশ সিং খেহর, বিচারপতি আর কে আগরওয়াল, বিচারপতি এস আব্দুল নাজির, বিচারপতি ধনঞ্জয় যশোবন্ত চন্দ্রচূড় একসঙ্গে যে রায়টি লিখেছেন, তাতে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা নিয়ে ২০১৩ সালে সু্প্রিম কোর্টের রায় যে ‘ভুল' ছিল, তা স্বীকার করা হয়েছে৷ বিচারপতি এস কে কউল এবং বিচারপতি এস এ ববডে আলাদা করে যৌন স্বাধীনতার পক্ষে রায় লিখেছেন৷ ফলে স্বাভাবিকভাবেই ৩৭৭ নিয়ে যে কিউরেটিভ পিটিশন এখনও সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন, তাতে জয়ের আশা দেখছেন সমকামীরা৷
এর আগে ২০০৯ সালে নাজ ফাউন্ডেশনের মামলায় দিল্লি হাইকোর্ট জানায়, ‘‘৩৭৭ ধারার ‘প্রকৃতি বিরুদ্ধ যৌনকর্ম' অংশটি সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক৷'' সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যান জ্যোতিষী কৌশল৷ ২০১৩ল সালের ডিসেম্বরে দেশের শীর্ষ আদালত রায় দেয়, ‘‘৩৭৭ ধারা অসাংবিধানিক নয়৷ তবে কেন্দ্র সরকার চাইলে নতুন আইন করতে পারে৷'' আদালতের সেদিনের রায়ে অনেকেই হতাশ হয়েছিলেন৷ এরপর দিন কয়েক আগে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে তাঁরাই বেজায় খুশি৷ গত আড়াই দশক ধরে ভারতে সমকামী আন্দোলনের অগ্রণী সৈনিক পবনী ঢালি বা কলকাতার ‘ট্রান্সজেন্ডার উন্নয়ন বোর্ড'-এর সদস্য, রূপান্তরকামী নারী রঞ্জিতা সিং বলেন, ‘‘আমার বিশ্বাস, মূল ধারার বাইরের যৌনতাও আইনি স্বীকৃতি পাবে৷ কিন্তু, তা নিয়ে আরও অনেক জলঘোলা হওয়ার আশঙ্কা করেছিলাম৷ এত তাড়াতাড়ি আশার আলো দেখব ভানিবি৷'' একই বক্তব্য, রূপান্তরকামী মানুষদের৷ তাই শোরগোল পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও৷
সমকামিতা নিয়ে সদ্য প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি খেহর-সহ চার বিচারপতিই একমত৷ তাঁরা বলেছেন, ‘‘সুরেশ কৌশল বনাম নাজ ফাউন্ডেশন মামলার রায়ে যেভাবে সু্প্রিম কোর্ট দিল্লি হাইকোর্টের রায় খারিজ করে বলেছিল, এলজিবিটি-দের ‘তথাকথিত অধিকার' রক্ষার উৎসাহেই হাইকোর্ট নানা দেশের দৃষ্টান্তে আস্থা রেখেছে, সেটা ‘ঠিক' হয়নি৷'' এঁদের মতে, ‘‘যৌন সত্তা ব্যক্তির অস্তিত্বের অচ্ছেদ্য অংশ৷ সমতা, স্বাধীনতা ও বেঁচে থাকার অধিকারের সমান৷ এলজিবিটি সম্প্রদায় যৌন সংখ্যালঘু হতে পারেন, কিন্তু সেই যুক্তিতে তাঁদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না৷ তথাকথিত মূলস্রোত বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যৌন সংখ্যালঘুদের নিয়ে কী ভাবছেন, তাতেও কিছু আসে-যায় না৷'' বিচারপতিরা মনে করছেন, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় সামান্য কয়েকজন শাস্তি পেয়েছেন৷ ফলে তাতে বিশাল কোনো অধিকার লঙ্ঘন হয়নি – কৌশল মামলার এই যুক্তি ‘ত্রুটিপূর্ণ এবং সমর্থন-অযোগ্য৷
এখনও ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ৩৭৭ ধারা রদ করার লড়াই চলছে৷ এই প্রসঙ্গে বিচারপতিরা বলেছেন, ‘‘অন্য বেঞ্চে বিচারাধীন মামলায় অন্য বেঞ্চ রায় দেবে৷'' তবে সমাজকর্মীরা মনে করছেন, আদালতের এই পর্যবেক্ষণে ৩৭৭ রদ করার লড়াই অনেকটাই এগিয়ে রইল৷ সমকামী নারীদের এক সংগঠনের নেত্রী মালবিকার কথায়, ‘‘সাতরঙা সমাজ গড়তে ৩৭৭ রদ করতেই হবে৷''
প্রতিবেদনটি নিয়ে আপনার মন্তব্য জানান, লিখুন নীচের ঘরে৷