সাংবাদিকরা সব পক্ষের হামলার শিকার হচ্ছেন
৭ আগস্ট ২০১৮রবিবার শিক্ষার্থীদের আন্দেলন চলাকালে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় সাংবাদিক এবং ফটো সাংবাদিকদের ওপর টার্গেট করে হামলা করা হয়৷ হেলমেট পরে এই হামলায় দুর্বৃত্তরা রড, জিআই পাইপ এবং চাপাতি ব্যবহার করে৷ হামলায় মোট ১০-১২ জন সাংবাদিক আহত হন৷ তাঁদের মধ্যে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস বা এপি-র এএম আহাদের অবস্থা গুরুতর৷ হামলায় আহত দৈনিক বণিক বার্তার ফটো সাংবাদিক পলাশ শিকদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা আগেও পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নানা ধরনের বাধার মুখে পড়েছি৷ কিন্তু এবার যেভাবে হামলা চালানো হয়েছে, তা অতীতে কখনো দেখিনি৷ আমাদের ওপর কয়েক দফা হামলা চালানো হয়৷ প্রথম দফা হামলার পর প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বের হবার পর আবারো হামলা করে তারা৷ আর সেটা তারা করে পুলিশের সামনেই৷ আমাদের কেউ রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি৷ আমরা যদি পালাতে না পারতাম তাহলে হয়ত আমাদের মেরেই ফেলত৷''
আরেকজন ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরাও তো ওই দিন খুন হয়ে যেতে পারতাম৷ আমার মনে হয়েছে হত্যার উদ্দেশ্যেই সেদিন হামলা হয়েছে৷''
২৯ জুলাই থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরুর পর থেকেই এবার সাংবাদিকরা নানাভাবে হামলার শিকার হন৷ এই হয়রানির অভিযোগ দু'পক্ষের বিরুদ্ধেই রয়েছে৷ সোমবারও সাংবাদিকরা বসুন্ধরা ও আফতাব নগর এলাকায় হামলা এবং হয়রানির শিকার হন৷ ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি এলকায় একজন নারী সাংবাদিককে হয়ারানি করে পুলিশ৷ সাংবাদিকরা অভিযোগ করেন, কোনো পক্ষই সাংবাদিকদের সুরক্ষায় কাজ করেন না৷
সাংবাদিকদের ওপর এই হামলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে মঙ্গলবার ঢাকায় সাংবাদিকরা বিক্ষোভ করেন৷ কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারা এলাকায় তরুণ সাংবাদিকদের উদ্যোগে সকাল ১০টায় বিক্ষোভ ও মানববন্ধন হয়৷ এরপর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের আয়োজনে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়৷ এই সব সমাবেশে সাংবাদিক, ফটো সাংবাদিক সবাই অংশ নেন৷ ফটো সাংবাদিকরা ক্যামেরা রেখে প্রতিবাদ জানান৷ আর সাংবাদিকরা প্রতিবাদ জানান ক্যামেরা, কলম এবং লেখার প্যাড নীচে রেখে৷ তাঁরা আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের চিহ্নিত ও আটক করার দাবি জানান৷ নয়ত সারাদেশের সাংবাদিকদের নিয়ে আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়ার কথা বলেন তাঁরা৷
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের কোষাধ্যক্ষ দীপ আজাদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাংবাদিকরা দুই ধারায় বিভক্ত৷ এই বিভক্তির সুযোগ নিয়ে সাংবাদিকদের নির্যাতন করে পার পেয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসীরা৷ কিন্তু সরকারকে অবশ্যই নির্যাতনকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে৷''
সাংবাদিকদের ওপর হামলার পর, সোমবার, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দাবি করেন, ‘‘কোনো অনুপ্রবেশকারী হামলা করে থাকতে পারে৷'' তাই তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘যারা হামলা করেছে আপনারা তাদের নাম, ঠিকানা ও তালিকা দিন, আমরা ব্যবস্থা নেব৷''
এর জবাবে মঙ্গলবার, বাংলাদেশ ফেডারেল জার্নালিস্ট ইউনিয়নের সভাপতি মোল্লা জালার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যারা সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেছে, তাদের ছবি সবখানে প্রকাশ হয়েছে৷ আমরা কেন তালিকা দেবো? সরকারকেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ তারা যে দল বা যার লোকই হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে৷ আমরা শনিবার পর্যন্ত দেখব সরকার কী ব্যবস্থা নেয়৷ এরপর প্রয়োজন হলে কঠোর কর্মসূচিতে যাব৷''
তিনি বলেন, ‘‘এবারে হামলা ছিল হত্যার উদ্দেশ্যে৷ হামলার এই ধরন দেখে আমরা আতঙ্কিত৷ সাংবাদিকরা যেহেতেু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন, তাই পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় তাঁদের নিরাপত্তা দিতে হবে৷ কিন্তু আমরা এবার দেখলাম সাংবাদিকরা পুলিশসহ সব পক্ষের হামলার শিকার হয়েছেন৷ এভাবে চলতে পারে না৷''
সংবাদপত্র পরিষদও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের ওপর নির্বিচার হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করেছে৷ সোমবার পরিষদের পক্ষে মহাসচিব মাহফুজ আনাম এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘শিক্ষার্থীদের চলমান নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে এপি-র একজন এবং ফ্রিলান্সার একজনসহ বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের প্রায় ২৪ জন ফটোসাংবাদিক ও প্রতিবেদককে শারীরিকভাবে নাজেহাল করা হয়েছে৷ এ সময় আন্দোলনবিরোধী এ সব হামলাকারী লাঠিসোঁটা নিয়ে কর্তব্য পালনরত সাংবাদিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ও তাদের নির্বিচারে পেটায়৷ পুলিশের চোখের সামনে এ সব ঘটনা ঘটলেও হতভাগ্য সাংবাদিকদের বাঁচাতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি পুলিশ৷ নিরাপদ সড়ক আন্দোলনবিরোধী এ সব হামলাকারী সাংবাদিকদের ক্যামেরা ও ভিডিও সরঞ্জাম ভেঙে ফেলে এবং মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়৷''
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘বাংলাদেশের সংবিধানেই সুরক্ষিত রয়েছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা৷ গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিলে অনিবার্য ধ্বংস হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত প্রিয় গণতন্ত্র৷''
এদিকে সংবাদ পরিবেশনের বিষয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের দু'টি বেসরকরি টেলিভিশর চ্যানেল একাত্তর টেলিভিশন এবং নিউজ টোয়েন্টি ফোর টেলিভিশনকে সতর্ক করে দিয়েছে৷
৫ আগস্ট ওই দু'টি চ্যানেলকে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, ১ আগস্ট ( শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে) সম্প্রচারিত কিছু খবরে জনমতে আতঙ্ক সৃষ্টি এবং জনবিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে৷ চিঠিতে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার পরিপন্থি এবং জনবিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে উৎসাহ দিতে পারে' এমন অনুষ্ঠান, সংবাদ বা দৃশ্য সম্প্রচার না করতে অনুরোধ করা হয়েছে৷
তথ্যমন্ত্রী সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার পত্রিকা এবং অনলাইন সম্পাদকদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছেন৷ আর মঙ্গলবার বৈঠক হয়েছে টেলিভিশন চ্যানেল মালিকদের সঙ্গে৷ বৈঠক শেষে একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদ একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা গত কয়েকদিনে ওভার অল সরকারের সঙ্গে সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং তাঁদের প্রটেকশন নিয়ে কথা বলেছি৷ কারণ সাংবাদিকরা সব পক্ষের কাছ থেকে মার খাচ্ছে৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে আমাদের ওপর কোনো চাপ নাই৷ বরং আমরা গত কয়েকদিনের আলোচনায় তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, মেইন স্ট্রিম মিডিয়াকে স্বাধীনভাকে কাজ করতে না দিলে গুজব পাখা মেলে৷ এটা বুঝতে হবে৷ মেইন স্ট্রিম মিডিয়া যতটুকু ঘটেছে তা যদি দেখায়ও এতে আখেরে লাভ আছে৷ বন্ধ করার মধ্যেই ক্ষতি বেশি৷''
এদিকে মঙ্গলবার সকালে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, ‘‘কর্তব্যরত সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে যারা হামলা করেছে, তাদেরকে শনাক্ত করা হয়েছে৷ তাদের ছবি আমাদের হাতে এসেছে৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মৌখিকভাবে অনুরোধ করেছি এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য৷ তবে আমরা লিখিতভাবেও ব্যবস্থা নিতে বলবো৷ এই হামলার ঘটনা দুঃখজনক৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকার ও তথ্য মন্ত্রণালয় সব সময় সাংবাদিকদের পাশে আছে৷ সাংবাদিকদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেক ভালো৷''
বিকেলে এক চিঠিতে সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছেন তথ্যমন্ত্রী৷