সামাজিক মাধ্যমে আসক্তি
১ আগস্ট ২০১৬জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও আবাসিক মনঃচিকিৎসক ডা. তারিকুল আলম ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আগে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যে ধরণের বন্ধন ছিল, এখন তা নেই৷ ফলে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে অনেকে সময় কাটাতে বেশি বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের পথ বেছে নিচ্ছে৷ এই মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক, কীভাবে তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, এ ক্ষেত্রে বাবা-মাদের করণীয় কী হতে পারে – এমন নানান বিষয়ে কথা বলেছেন ডাঃ আলম৷
ডয়চে ভেলে: সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহারের কারণে একজন মানুষের তো শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হচ্ছে, সেই ক্ষতির দিকটা কীরকম?
ডাঃ তারিকুল আলম: সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহারের কারণে শারীরিকের চেয়ে মানসিক ক্ষতি বেশি হচ্ছে৷ মোবাইল ফোন আর কম্পিউটার ব্যবহারের জন্য চোখ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি মেরুদণ্ডেও ব্যথা হতে পারে৷ হতে পারে ঘুমের সমস্যাও৷ তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে মূল যে সমস্যাটা হয় সেটা হলো ‘বিহেভিয়ার এডিকশন' অর্থাৎ ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি আসক্তি৷ আসক্তি যখন হয়ে যায়, তখন সে চাইলেই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে পারে না৷ তার কারণে দীর্ঘসময় ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন রকমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়৷
এই ধরনের কোনো রোগী কি এখন পর্যন্ত পেয়েছেন?
আমাদের কাছে এই ধরনের অনেক রোগী আসে৷ বিশেষ করে টিনএজারদের বাবা-মা তাঁদের সন্তানদের নিয়ে আসছেন৷ তাদের পড়াশোনায় মনোযোগ কমে গেছে৷ তার আচরণ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে৷ তার সামাজিক যোগাযোগে পরিবর্তন হচ্ছে৷
এই রোগীদের প্রতি আপনাদের কী পরামর্শ থাকে?
প্রত্যেকটা জিনিসের একটা ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক থাকে৷ এই সোস্যাল মিডিয়া মানুষ যে উদ্দেশ্যে ব্যবহার শুরু করেছিল এখন অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে সেটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আমরা কখনই বলি না যে এগুলো ব্যবহার করা যাবে না৷ তবে ব্যবহারের একটা লিমিট আছে৷ সেটা মেনে চলতে হবে৷ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে৷ নির্দিষ্ট সময় থাকবে৷ যাতে তার মধ্যে আসক্তি তৈরি না হয়৷ এটাই আমাদের পরামর্শ৷
এই যে লিমিটের কথা আপনি বলছেন৷ সেটা নিয়ে কি কোনো গবেষণা আছে যে, দিনে কত ঘণ্টা ব্যবহার করলে চোখ বা মস্তিষ্ক ভালো থাকবে?
এই ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনো গবেষণা নেই৷ তবে যাঁরা কম্পিউটারে কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে কিছু নিয়মকানুন আছে৷ যেমন একটানা ৩০ মিনিটের বেশি কাজ করা যাবে না৷ একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে৷ একটা অ্যাঙ্গেল থেকে ব্যবহার করতে হবে৷ এখন নির্ভর করছে কোন বয়সে ব্যবহার করছে৷ একজন স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীর ইন্টারনেট যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীর৷ আসলে বিষয়টা হলো, এটা তার প্রয়োজন কিনা৷ আজকাল তো অনেকে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে৷ ইন্টারনেট দিয়ে অনেকে উপার্জনও করছেন৷ আমাদের মতে, যার যতটা প্রয়োজন ততটা ব্যবহার করতে হবে৷
আপনাদের কাছে সাধারণত কেমন বয়সের রোগী আসেন?
আমাদের কাছে যারা আসে তাদের রোগী বলব না, তারা পরামর্শ নিতে আসে৷ এদের মধ্যে ক্লাস সেভেন থেকে শুরু করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আছে৷ সন্তানদের মধ্যে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, তারা তো আর বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণে থাকে না৷ বেশি যারা আসে তাদের বয়স ২০ বছরের মধ্যে৷ বড়দের ক্ষেত্রে রিলেশনে সমস্যা হতে পারে৷ পারিবারিক সমস্যা হতে পারে৷
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে অনেকে উপার্জন করছেন৷ তারাও তো অনেক সময় এগুলো ব্যবহার করছেন৷ তাহলে তাদের ক্ষতির দিকটা কেমন?
এখানে এটা যে করছে সে কিন্তু অ্যাবিউজ করছে না৷ তার ক্ষতির দিকটাও আছে৷ তার শারীরিক ক্ষতি হতে পারে, চোখের সমস্যা হতে পারে৷ কিন্তু মানসিক ক্ষতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই৷ তবে তারও কম্পিউটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে বৈজ্ঞানিক নিয়মকানুন আছে সেটা মেনে চলা উচিত৷ কেউ যদি কোনো জিনিস বেশিও ব্যবহার করে তবে সেটা যদি ‘প্রপার’ হয় তাহলে তাতে ক্ষতির সম্ভাবনা কম৷
আপনাদের কাছে যারা পরামর্শ নিতে আসছে তাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতির দিকটা কী?
বাবা-মা বিষয়টা বুঝতে পারেন যখন তাঁদের সন্তানদের অ্যাকাডেমিক দিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ এখন পারিবারিক বন্ধনটা দুর্বল হয়ে গেছে৷ বাবা-মা সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করেন না৷ স্কুল-কলেজ থেকে সন্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসা শুরু করলে বা রেজাল্ট ভালো হচ্ছে না – এমন পরিস্থিতি হলে বাবা-মা নোটিশ করছেন৷ তখন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছেলে সারাদিনই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নিয়ে ব্যস্ত আছে৷ এই ধরনের সম্পর্ক রিলেটেড সমস্যা নিয়েই অভিভাবকরা বেশি আসেন৷
যারা সমস্যা নিয়ে আসছে, তাদের সমস্যায় পড়ার কারণ কী বলে?
আগে যেমন পারিবারিক বন্ধন ছিল৷ বাবা-মা, ভাই-বোনের মধ্যে একটা সু-সম্পর্ক ছিল, এখন সেটা অনেকটা দুর্বল হয়ে গেছে৷ এখন আর পারিবারিক বন্ধন নেই, যে যার মতো হয়ে গেছে৷ যে ছেলেটা সারাদিন ফেসবুক ব্যবহার করছে, সে আসলে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে সময় কাটাতে এই পথ বেছে নিয়েছে৷ পরিবারের সঙ্গে বন্ধন কমে যাওয়ার কারণে এই ধরনের মাধ্যমে তার যোগাযোগটা বেড়ে যাচ্ছে৷
অভিভাবকদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
স্বাধীনতা সবারই দরকার৷ কিন্তু আমরা যারা বাবা-মা আমাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে৷ যখন কোনো সমস্যা হচ্ছে তখন আমরা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি৷ একটা বাচ্চা যে কীভাবে বড় হচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে, কীভাবে বড় হওয়া উচিত এই জায়গাগুলোতে ছোটবেলা থেকেই মনোযোগ দিতে হবে৷ একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর চাইলেও অনেক কিছু হয় না৷ কারণ যে বাবা-মা আপনাকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অভ্যস্ত করছেন, তিনি কিন্তু আপনার লিমিট ঠিক করে দিচ্ছেন না৷ এই জায়গায় প্রথম থেকেই বাবা-মাকে সতর্ক হতে হবে৷ প্রযুক্তি ব্যবহারে খুব বেশি বাড়াবাড়ি হওয়া উচিত না৷ এটা বাবা-মাকে বুঝতে হবে৷
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চান? তাহলে নীচে মন্তব্যের ঘরে লিখতে পারেন...