ঈদ উত্সবে বৈষম্য
৯ আগস্ট ২০১৩ঈদের দিনেও রিকশা চালাতে হয়েছে মো. শাহ আলমকে (৪২)৷ রংপুরের মঙ্গা প্রবণ এলাকা থেকে ঢাকায় এসেছেন ৫ বছর আগে ৷ থাকেন বসিলা এলাকার বস্তিতে৷ ৪ ছেলে মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর সংসার৷ স্ত্রী জাহানারা বেগম গৃহকর্মীর কাজ করেন৷ আর তিনি রিক্সা চালান৷ এতে তাঁদের ৬ জনের সংসার কোনোভাবে চলে যায়৷ কিন্তু ঈদ-কোরবানির মত বড় কোনো উত্সবে তাঁরা পড়েন বিপাকে৷
তিনি যেমন ঈদের দিন সকালেই রিক্সা নিয়ে বেরিয়েছেন৷ তাঁর স্ত্রীও সকালেই কাজে বেরিয়েছেন৷ তাঁদের জীবনে ঈদ বাড়তি কোনো সুখবর বয়ে আনেনা৷ শাহ আলম বললেন, বরং এক ধরনের কষ্ট তাঁদের ওপর চেপে বসে৷ কারণ তাঁদের সন্তানদের তাঁরা তেমন কিছুই দিতে পারেন না ঈদে৷ অথচ যাত্রীদের সঙ্গে দামি পোশাক আর বাজারের বোঝা বয়েছেন৷ বাইরে থেকে দেখছেন আলো ঝলমলে দোকানপাট৷ যেখানে তাঁরা ঢোকারও সাহস করেন না৷ এই বেদনার কথা একজন শাহ আলমেরই শুধু নয়৷ ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে এরকম অন্তত ৮ কোটি শাহ আলম পাওয়া যাবে৷
দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামায়াত হয় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায়৷ এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷ সেই জামায়াতের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বললেন, ঈদের আদর্শ এক দিনের জন্য নয়৷ সারা বছরের জন্য৷ ধনী-গরিবের বৈষম্য কমানোর কথা বলে ঈদ৷ আর বলা হয়েছে ধনীর সম্পদে আছে গরিবের অধিকার৷ তাহলে এই ঈদে তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাইনা কেন?
জবাবে তিনি বলেন, ঈদ উত্সব করা আর তার আদর্শকে ধারণ করা এক জিনিস নয়৷ ঈদে দামি পোশাক আর বিলাসব্যসন যেমন একদিকে, অন্যদিকে এক শ্রেণির মানুষের আছে না পাওয়ার বেদনা৷ এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায়না৷ ঈদ উত্সবের নামে সম্পদের উত্কট প্রকাশ ইসলাম সমর্থন করেনা৷ তাঁর মতে, ঈদ যেখানে অসাম্য দূর করবে, সেখানে কখনো কখনো ধনী গরিবের পার্থক্য আরো তীব্রভাবে প্রকাশ পায়৷ যা ইসলাম সমর্থন করে না৷ ইসলাম মনে করে ধনীর সম্পদে আছে গরিবের অধিকার৷
সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে এখন ৩১.৫ ভাগ লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে৷ আর এই সংখ্যা হল ৫ কোটিরও বেশি৷ আর এদের মধ্যে বড় একটি অংশ হতদরিদ্র৷ তবে এই দারিদ্র্য সীমার উপরে বড় একটি অংশ যারা নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত, তারাও তেমন ভাল নেই৷ উত্সব আয়োজনে তাঁরাও দরিদ্রদের মত সংকটে পড়েন৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, এটা দুঃখজনক হলেও সত্য, যে ঈদ-কোরবানির মত উত্সব আয়োজনে আয় বৈষম্য বা ধনী-দরিদ্রের পার্থক্যটা নগ্নভাবে প্রকাশ পায়৷ কারণ যারা ধনী, তাদের বড় একটি অংশ তাদের সম্পদের প্রদর্শন করার সুযোগ পান এই সময়ে৷ তবে এও সত্য যে ইসলামের বিধি বিধানের কারণে এই সময়ে ধনীদের কিছু সম্পদ গরিবের কাছে যায়৷ তবে এতে সাম্য বা সমতা আসেনা৷
তিনি জানান, বাংলাদেশে এখন বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৯২০ ডলারের বেশি৷ কিন্তু এই মাথাপিছু আয় দিয়ে বাস্তব অবস্থা বোঝা যাবেনা৷ কারণ অল্প সংখ্যক মানুষের হাতে অধিকাংশ সম্পদ পুঞ্জিভূত৷ আর মাথাপিছু আয় হল জাতীয় আয়ের মাথা পিছু গড় হিসাব৷ তিনি বলেন, বণ্টন ব্যবস্থা ভাল না হলে মাথা পিছু আয় বাড়লেও আয় বৈষম্য কমেনা৷ গরীব মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বাড়েনা৷ যাদের বেশি সম্পদ, তাঁদের ওপর বেশি কর আরোপ করে দরিদ্র মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা এবং বাজার ব্যবস্থাকে দরিদ্রবান্ধব করলে এই পরিস্থিতি থেকে বেড়িয়ে আসা সম্ভব৷