সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি
২৫ আগস্ট ২০১৪ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্তে মাত্র তিনটি মূল প্রশ্নের উত্তর খোঁজা ছাড়া পুলিশের কিছু করার ছিল না৷ এক, বাজার থেকে ঠিক কত টাকা তুলেছিল সারদা চিট ফান্ড, দুই, সেই টাকা কোথায় গেল এবং তিন, কে বা কারা এর দৌলতে লাভবান হয়েছিল৷ অথচ টানা এক বছর ধরে তদন্ত করেও এই তিনটি বিষয়ে প্রায় কিছুই জানতে পারেনি রাজ্য পুলিশের ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট বা সিআইডি৷ ফলে কলকাতা হাইকোর্টে রাজ্য সরকারের পক্ষে যতই জোরালো সওয়াল করা হোক না কেন যে সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত ঠিক পথেই এগোচ্ছে, তা খারিজ করে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই-কে তদন্তের ভার দেওয়ার পক্ষে রায় দেয় আদালত৷
সিবিআই তদন্ত শুরু করার পর বার বার অভিযোগ ওঠে রাজ্য পুলিশের তরফ থেকে চরম অসহযোগিতার৷ এই মামলার প্রধান আসামী সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন এবং অন্য এক অভিযুক্ত, তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ, পরবর্তীতে দল থেকে সাসপেন্ড হওয়া সাংবাদিক কুনাল ঘোষ – দুই বিচারাধীন বন্দিই বার বার অভিযোগ করেন যে রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দারা তদন্তের নামে কার্যত সারদা দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ লোপাট করতে ব্যস্ত৷ তা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার এই তদন্ত সম্পর্কে আদতে কতদূর দায়িত্বজ্ঞানহীন, তা সম্প্রতি ফের বোঝা গেল সারদা-নথি বোঝাই গোটা একটি আলমারি হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায়৷ প্রশাসন তখনও নির্বিকার প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল যে, রাইটার্স বিল্ডিং থেকে নবান্ন ভবনে সচিবালয় সরানোর সময় সম্ভবত আলমারিটি অন্য কোথাও রাখা হয়েছে!
তবু এই মামলার তদন্তে পশ্চিমবঙ্গে সিবিআই-এর প্রথম গ্রেপ্তারিটি অনেকেরই ঘুম কেড়ে নিয়েছে৷ কলকাতার দুই প্রধান ফুটবল ক্লাবের অন্যতম ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্তা দেবব্রত সরকারকে কয়েক দফায় জেরার পর গ্রেপ্তার করেছে সিবিআই৷ বিতর্কিত এই ক্লাবকর্তা সারদার চিট ফান্ড ব্যবসা অবাধে চলার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক এবং দেশের আর্থিক লেনদেন নিয়ামক সংস্থা সেবি-র কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন বলে অভিযোগ৷ এবং সারদা-মালিক ফেরার হওয়ার আগে সিবিআই-কে যে চিঠি লিখে গিয়েছিলেন, তাতে তিনি জানিয়েছিলেন যে ওই রক্ষাকর্তার ভূমিকা পালন করার জন্য দেবব্রত সরকারকে তিনি কোটি কোটি টাকা দিয়েছেন প্রায় তিন বছর ধরে৷
এছাড়াও সুদীপ্ত সেনের অভিযোগ ছিল, চিট ফান্ড ব্যবসার মাধ্যমে যে বিপুল অঙ্কের টাকা বাজার থেকে সারদা তুলেছিল, তা বেশিটাই খরচ হয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের দিতে, বা চাপে পড়ে অলাভজনক সংস্থা বাজারদরের থেকে অনেক বেশি দামে কিনতে গিয়ে৷ এ ছাড়া মিডিয়া ব্যবসায় লগ্নি করাটাও ভুল ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছিলেন সারদা-কর্তা৷ কেন্দ্রীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট এই প্রতিটি অভিযোগ খুঁটিয়ে দেখছে এবং এর মধ্যেই তদন্তে ধরা পড়েছে, রাজ্যের বস্ত্রমন্ত্রী, তৃণমূল বিধায়ক শ্যামাপদ মুখার্জি প্রাপ্যের থেকে অনেক বেশি দামে নিজের একটি লোকসানে চলা সিমেন্ট কারখানা সারদা গোষ্ঠীর কাছে বিক্রি করেছিলেন৷ কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে ইডি৷
যেমন একইভাবে একটি খবরের কাগজ সুদীপ্ত সেনকে কিনতে বাধ্য করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের আর এক রাজ্যসভার সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরান৷ তিনি আবার সুদীপ্ত সেনের থেকে টাকা নিয়েছিলেন, কিন্তু কাগজের মালিকানা হস্তান্তর করেননি! তাঁকেও সমন পাঠিয়েছিল সিবিআই, কিন্তু তিনি হাজির না হওয়ায় এখন আদালতে গিয়ে তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার কথা ভাবা হচ্ছে৷ তাঁর বাড়িতেও তল্লাসির জন্য হানা দিতে পারেন সিবিআই গোয়েন্দারা৷ এদিকে সুদীপ্ত সেন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আদালতে আর্জি জানিয়েছিলেন যে তাঁকে সিবিআই হেফাজতে পাঠানো হোক, কারণ তাঁর অনেক কিছু বলার আছে৷ আদালত সেই আর্জি মঞ্জুর করেছে৷
অন্যদিকে ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকার সিবিআই-এর জেরার জবাবে অনেক তথ্যই ফাঁস করছেন৷ যেমন জানা গিয়েছে যে সুদীপ্ত সেনকে চাপে রেখে নিয়মিত আদায় করা কোটি কোটি টাকার এক বড় অংশ আরও দুই ক্লাবকর্তা নিজেদের ব্যবসায় খাটাতেন৷ সেই দুই কর্তারও এবার ডাক পড়বে বলে অনুমান৷ এবং রাজ্যের রাজনৈতিক মহলের ধারণা, একে একে অনেক মাথাই এবার কাটা পড়বে৷ সিবিআই-এর খাঁড়া তাঁদের মাথার উপর ঝুলছে এবং ক্রমশ জাল গুটিয়ে আনছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা৷
রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার কেন সিবিআই-কে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ার ঘোরতর বিরোধী ছিল, সেটাও ক্রমশ স্পষ্টতর হচ্ছে!