বাজারে আগুন
২৮ অক্টোবর ২০১৩আবহাওয়া অফিসের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ২১শে অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে বর্ষাকাল বিদায় নেওয়ার কথা গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ থেকে৷ কোনো বছর তার এক সপ্তাহ আগেই হয়েছে বর্ষাবিদায়, কিন্তু পরে হয়নি৷ অর্থাৎ, এই শেষ তারিখের পর সচরাচর আর থাকেনি বৃষ্টির মেঘ৷ কারণ ঋতুচক্র অনুযায়ী, বর্ষা তো বটেই, শরৎ পার করে এটা হেমন্তকাল৷ শীতের আবাহনের সময়৷ সেখানে অন্ধ্র প্রদেশে নিম্নচাপের কারণে টানা তিনদিনের অঝোর বর্ষণে ভেসে গেল পশ্চিমবঙ্গ৷ জেলায় জেলায় দেখা দিল বন্যা পরিস্থিতি৷ স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত হলো কলকাতা-সহ সমস্ত জেলাশহরে৷ ২১ অক্টোবর বর্ষার আনুষ্ঠানিক বিদায়ের সময়সূচির উপর ভরসা রেখে শহরের নিকাশি পাম্পগুলিকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছিল কলকাতা পুরসভা৷ ফলে প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে জলমগ্ন রইল কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকা৷
পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০ বছরে অক্টোবর মাসে এরকম ভারি বৃষ্টি হয়নি৷ অবশ্য বৃষ্টির পরিমাপ বলছে, এই হেমন্তকালে যে পরিমাণ বর্ষণ হলো, তা এবার বর্ষাকালেও হয়নি৷ কিন্তু এই তথ্য পরিসংখ্যানের বাইরে যেটা ঘটে গেল, প্রাক-শীতের অনেক সবজির ফলন ক্ষতিগ্রস্থ হল এই অকালবর্ষণে৷ ফলত, সাধারণভাবে শীতকালে সবজির দাম যে কিছুটা কম থাকে, এবার তার সম্ভাবনা কম৷ বরং এই শরতে বাজারে শাক-সবজি থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সমস্তকিছুর যে অগ্নিমূল্য নাভিশ্বাস তুলেছিল গেরস্থের, সেই চড়া দাম কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না৷
সাম্প্রতিক অতীতে এমন কখনও হয়নি যে বাজারদরের রাশ টানার জন্য এমন ঘন ঘন পাইকারি বাজারে হানা দিতে হয়েছে সরকারের এনফোর্সমেন্ট দপ্তরের অফিসারদের৷ কারণ প্রায় সমস্ত সবজির দাম গত এক বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে৷ যেমন ধরা যাক চারটি সবজির কথা, যেগুলো গড়পড়তা বাঙালির পাতে ‘থোড়-বড়ি-খাড়ার' থেকেও বেশি নিত্যনৈমিত্তিক৷ বেগুন, পটল, ভিন্ডি বা ঢ্যাঁড়স এবং কুমড়ো৷ এক বছর আগেও বেগুনের বাজারদর ছিল ৪০ টাকা কিলো৷ এখন সেটা ৭০ টাকা! পটল ছিল ২০টাকা কিলো, এখন সেটা ৫০ টাকা! মানে দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি৷ ভিন্ডি বা ঢ্যাঁড়সের দামও দ্বিগুণ হয়েছে – ৩০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ৬০ টাকা কেজি৷ আর নেহাতই সাধারণ যে কুমড়ো, গরিব মানুষের খাবার, তা-ই এখন ১৫ টাকা কেজি থেকে দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে ৩০ টাকা কিলো৷ ফলে রোজকার বাজারের হিসেব করতে গিয়ে রোজগেরে মধ্যবিত্তেরই নাভিশ্বাস উঠছে, গরিব মানুষের দুরবস্থা সেখানে আর বলার নয়৷
লক্ষ্যণীয়, এই মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় পেঁয়াজ নামক মহার্ঘ্য বিলাসদ্রব্যটির নাম নেই৷ কারণ, পেঁয়াজের ক্রমশ বাড়তে থাকা দাম যে কোনো যুক্তি-বুদ্ধিকে অস্বীকার করছে৷ এক বছর আগেও ২০ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে৷ এখন বাজারে সর্বনিম্ন দাম ৭০ টাকা৷ এর পর যে যা পারে দাম নিচ্ছে পেঁয়াজের, যা বাজারে বারবার সরকারি হানাদারিতেও বন্ধ করা যায়নি৷ বস্তুত সরকারি অনুরোধ, অনুশাসন, এমনকি চোখরাঙানিকেও মানতে চাইছে না বাজার দর৷ এর পাশাপাশি ভিনরাজ্য থেকে যা যা চালানি আসে পশ্চিমবঙ্গে, মাছ বা ডিম থেকে শুরু করে সব কিছুর দাম বেড়েছে৷ দাম বেড়েছে দুধের, পাঁউরুটির, চালের, ডালের৷
এর উপর এই অকালবৃষ্টি আরও আতঙ্কিত করছে মানুষকে, যেহেতু তা আরও মূল্যবৃদ্ধি প্রায় সুনিশ্চিত করছে৷ যেমন এবারই এই নিম্নচাপের জেরে টানা তিনদিনের বৃষ্টিতে মেদিনীপুর জেলায় ঢ্যাঁড়সের ফলন পুরো নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে খবর এসেছে৷ শীতের সবজি ফুলকপির ক্ষেতেও তাণ্ডব চালিয়েছে অকালবর্ষণ৷ এর পাশাপাশি প্রায় নিয়মিত ঘটছে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, যার দরুণ পরিবহন-খরচ বাড়ছে, সমস্ত জিনিসের দাম আরও বাড়ছে৷ ফলে নবান্নের মরশুমে গেরস্থের মুখে কতটা হাসি আদৌ থাকবে, সেই সন্দেহ কিন্তু থেকেই যাচ্ছে৷