অক্টোবর ১৯৭১: স্বাধীন রাষ্ট্র স্বীকৃতির দাবি, চাপে পাকিস্তান
২৭ অক্টোবর ২০২৩বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ও পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত ক্রমেই জোরালো হতে থাকে৷পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে বাড়তে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের তীব্রতা, যা যুদ্ধকালীন সময়ে মুজিবনগর সরকারের দক্ষতাকেই স্পষ্ট করে৷
অক্টোবরের প্রথম তারিখে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি উত্থাপিত হয়৷নিউইয়র্কের চার্চ সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রথম এ দাবিটি তোলেন মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত ও বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা আবু সাঈদ চৌধুরী৷স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তি এবং বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের অপসারণের দাবিও তোলেন তিনি৷
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের রাজনৈতিক বিতর্কে প্রায় ১০০ দেশের প্রতিনিধি বাংলাদেশ ইস্যুতে বক্তব্য দেয়৷ তাদের মধ্যে ৫০টি দেশই বাংলাদেশ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে৷ তারা বাংলাদেশ সমস্যার দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান এবং শৃঙ্খলা ফেরানোর কথাও তুলে ধরে৷
ভ্যাটিকানের পোপ জন পলের আহ্বানে অক্টোবরেই রোমের বিভিন্ন গির্জায় বাংলাদেশের জন্য বিশেষ প্রার্থনা সভার আয়োজনের পাশাপাশি উপবাস পালন করা হয়৷ প্রার্থনাসভায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য সংগ্রহ করা হয় অর্থসহযোগিতাও৷
১০ অক্টোবর পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একমাত্র ছেলে রাশেদ সোহরাওয়ার্দী লন্ডনে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে এর সাফল্য কামনা করেন৷দৃঢ় কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘‘বিগত ২৪ বছর ধরে বাঙালিরা অর্থনৈতিকভাবে নিগৃহীত ও রাজনৈতিকভাবে অবদমিত হয়ে আসছে৷এখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিচালিত গণহত্যা এবং অন্যান্য ঘৃণ্য অনাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে৷এই সংগ্রাম জয়যুক্ত হবেই৷’’
সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘প্রাভদা'১০ অক্টোবর বাংলাদেশের ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নেয়৷ এক প্রতিবেদনে পত্রিকাটিতে বলা হয়, ‘‘পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ও নৃশংস গণহত্যার দায় এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল হিসেবে পাকিস্তানের প্রশাসন শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার নিয়ে তামাশা করছে৷সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে পাকিস্তান সরকার অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করছে৷''
প্রাভদায় আরো লেখা হয়, ‘‘ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হওয়ায় সোভিয়েত জনগণ বিক্ষুব্ধভাবে এর প্রতিবাদ করছে৷ তারা শেখ মুজিবুর রহমানের অবিলম্বে মুক্তি, পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান এবং শরণার্থীদের নিরাপদে দেশে প্রত্যাবর্তনেরও দাবি করছে৷’’ (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ- ত্রয়োদশ খণ্ড)
এসব ঘটনা পাকিস্তান সরকারকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে এক ধরনের চাপ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ-গবেষকগণ৷
মোনায়েম খান হত্যা
এদিকে অক্টোবরের ১৩ তারিখে দেশের অভ্যন্তরে গেরিলাদের এক অপারেশন চিন্তায় ফেলে দেয় পাকিস্তানি সামরিক সরকারকে৷ পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর আবদুল মোনেম খান ওরফে মোনায়েম খান ছিলেন পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ুব খানের ঘনিষ্ঠ সহায়তাকারী৷ তাই বাঙালিদের কাছে তিনি ছিলেন ঘৃণ্য একজন৷
ঢাকার বানানীতে কঠোর নিরাপত্তার আবরণ ভেদ করে বাড়িতে ঢুকে মোনায়েম খানকে হত্যা করেন ঢাকার গেরিলা বীরপ্রতীক আনোয়ার ও বীরপ্রতীক মোজাম্মেল হক৷দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে তারা ছিলেন ক্যান্টনমেন্ট বিশেষ গেরিলা গ্রুপের সদস্য৷ ওই অপারেশনে সহযোগিতা করেছিলেন শাহজাহান ও মোখলেস৷ তারা দুইজনই কাজ করতেন মোনায়েম খানের বাসায়৷
এই দুর্ধর্ষ অপারেশন সম্পর্কে বীরপ্রতীক আনোয়ার হোসেন বলেন, "মোনায়েম খানের বাড়ির পুরো নকশা তৈরি করি শাহজাহান ও মোখলেসের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে৷ বাড়িটির চারদিকে দেয়াল, ওপরে কাঁটাতারের বেড়াও ছিল৷ পাকিস্তানি সেনা ও পুলিশ ছিল সার্বক্ষণিক পাহারায়৷ বাড়ির একটা দেয়ালের মাঝখানটা ভাঙা৷ তা দিয়ে অনায়াসে একজন ঢুকতে পারবে৷ সে সুযোগটিই কাজে লাগাই আমরা৷
মোনায়েম খানের বাড়িটি ছিল বনানী কবরস্থান সংলগ্ন৷ তখন খুব বেশি কবর ছিল না৷ খুব জংলা ছিল৷ আমরা জড়ো হবো সেখানেই৷আরেক সহযোদ্ধা নুরুল আমিনও থাকবে৷ মোজাম্মেল তার মতো করে পৌঁছে যাবে৷
ছোলমাইদে আমাদের অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে স্টেনগান নিয়ে আসি ফোল্ড করে, চটের ব্যাগে৷ গ্রেনেড ও পি-ফোর বোমাও নিই৷ তারিখটা ১৩ অক্টোবর৷ সন্ধ্যার পর রওনা হই৷ অপারেশন হয় আনুমানিক রাত সাড়ে ৮টায়৷
ব্যাগ নিয়ে রিকশায় বনানী ব্রিজ পার হয়ে পৌঁছি বনানী কবরস্থানে৷ মোজাম্মেল ও নুরুল আমিন অপেক্ষায় ছিল৷
স্টেনগানটা নিই আমি আর মোজাম্মেলকে দিই হ্যান্ড গ্রেনেডটা৷ফায়ার করার পরেও যদি কোনো সমস্যা হয়, তাহলে গ্রেনেড ছোঁড়া হবে৷এমনটাই ছিল পরিকল্পনা৷
কবরস্থানের দেয়ালঘেঁষা মোনায়েম খানের বাড়ির দেয়ালের ভাঙা অংশ দিয়ে ভেতরে ঢুকি আমরা৷ অতঃপর কলাগাছের বাগানে অপেক্ষায় থাকি৷
শাহজাহান এসে বলে, ‘আপনারা এখানেই বসেন৷ সাহেব এখনো ওপর থেকে নামেন নাই৷’
১০ মিনিট পরেই সে ফিরে এসে বলে, ‘সাহেব নামছে৷'
মোনায়েম খানের পজিশনটা জানতে চাইলাম৷ সে বলে, ‘পশ্চিম দিকে মুখ করা তিনজন লোকের মাঝখানেই সাহেব বসা৷’
স্টেনগান নিয়ে নীচতলায় ড্রইংরুমের দরজা ঠেলে ঢুকে যাই৷ মাত্র ১৫ ফিট সামনে তারা৷ মাঝের ব্যক্তিকে টার্গেট করেই গুলি করি৷সঙ্গে সঙ্গে মোনায়েম খান উপুর হয়ে পড়ে যান, একটা চিৎকারও দেন৷এইটুকু এখনো স্মৃতিতে আছে৷
পেছনে ব্যাক করতেই মোজাম্মেল সঙ্গে সঙ্গে গ্রেনেড চার্জ করে৷কিন্তু তার গ্রেনেডটা কোনো কারণে বার্স্ট হয়নি৷পরে শুনেছি মোনায়েম খানের সঙ্গে (দুই পাশে) ছিল প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী আমজাদ হোসেন আর মেয়েজামাই জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল৷
মোনায়েম খান মারা গেছেন- এটা জানি পরদিন, রেডিওর সংবাদে৷ আশপাশের লোকেরা আলাপ করছিল, ‘মোনায়েম খানরে মুক্তিযোদ্ধারা মাইরা ফেলছে৷' সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে খবরটি৷”
মোনায়েম খানের হত্যার খবরে তৎকালীন মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ এবং ডা. এ এম মালিকের মন্ত্রিসভার মন্ত্রীদের মনোবাল ভেঙে পড়ে৷অনেকেই গোপন বৈঠক করে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগেরও ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল বলেও শোনা যায়৷ মুক্তিবাহিনীর ভয়ে সাবেক গভর্নরের শেষকৃত্যে উপস্থিত হননি অনেক নেতা৷শুধু তাই নয়, এ ঘটনার পর পাকিস্তান সরকারের উর্ধ্বতন বেসামরিক কর্মকর্তারাও অফিসে যাওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলেন৷
ভারতে ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’
একাত্তরে ভারতে আশ্রয় নেয়া প্রায় এক কোটি বাঙালিকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব পড়ে সে দেশের ইন্দিরা গান্ধী সরকারের ওপর৷ভারতের কিছু রাজ্যের মানুষ এতে নাখোশ হয়৷ শরণার্থীদের ফিরিয়ে দিতে আর মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য না করতে নানাভাবে তারা সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকে৷
ওই সময়েই পরিকল্পনা হয়, বাংলাদেশ থেকে দিল্লি পর্যন্ত ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা' আয়োজনের৷এতে অংশ নেন বিভিন্ন জেলা থেকে আগত বাংলাদেশের ৩৮ জন শিক্ষিত যুবক৷ ভারত সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়, মুজিবের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন স্মারকলিপি প্রদান, পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক গণহত্যা ও হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা তুলে ধরে স্বাধীনতার পক্ষে ভারতীয় জনমত গড়ে তোলাই ছিল এর উদ্দেশ্য৷
পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে জনসভা করতেন৷গণহত্যা সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে আহ্বান জানাতেন বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর৷ দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হতে থাকে পদযাত্রার খবর৷এভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে ভারতীয়, তথা বিশ্ব জনমত গড়তে ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল৷
পদযাত্রী দলের ডেপুটি লিডার-০২ ছিলেন কামরুল আমান৷একাত্তরে তিনি নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র ছিলেন৷ ঐতিহাসিক সেই পদযাত্রার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে পদযাত্রাটি এগিয়ে নেওয়ার সার্বিক পরিকল্পনায় যুক্ত হয় ‘অখিল ভারত শান্তি সেনা মণ্ডল' নামের একটি সংগঠন৷এদের সহযোগিতা করে গান্ধী পিচ ফাউন্ডেশন৷মূল উদ্যোক্তা ভারতের অহিংস সর্বদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং আহ্বায়ক ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দীনেশ চন্দ্র মুখার্জি৷
পদযাত্রার আগাম কর্মসূচি ইংরেজি ও হিন্দিতে গণমাধ্যমগুলোতে জানিয়ে দিতেন উদ্যোক্তারা৷প্রায় দেড় মাস দলটিকে প্রতিদিন গড়ে ১৫-১৬ মাইল পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যেতে হতো৷ বিকেলের দিকে স্থানীয়ভাবে আয়োজন করা হতো জনসভার৷ উঠোন বৈঠকও চলে অগণিত৷দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে চলে মতবিনিময়ও৷এভাবে দলটি মুর্শিদাবাদ, সেইনথিয়া, সুরি, শান্তিনিকেতন, ককশা, দুর্গাপুর, রানীগঞ্জ, আসানসোল, নিয়ামতপুর, কুলটি, চিত্তরঞ্জন ও বিহার, পাটনা, লখনৌ, আগ্রাসহ প্রভৃতি জায়গায় পদযাত্রা করে৷
৩০ জানুয়ারি গান্ধী প্রয়াণ দিবসে দিল্লির রাজঘাট গান্ধী সমাধিতে পদযাত্রাটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তার আগেই স্বাধীনতা লাভ করায় ১৭ ডিসেম্বর ভারতের উত্তরপ্রদেশে এসে সেটি শেষ হয়৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক জাতীয়তাবাদটা মানুষের মনের ভেতরই গাঁথা থাকে৷ কে কোন দেশের, সেটা বড় কথা নয়৷মানুষের মুক্তির, মানুষের স্বাধীনতার জন্য মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়ায়৷একাত্তরে এটাই প্রমাণ করেছিল ভারতীয় জনসাধারণ৷''
পদযাত্রার দলটি স্বাধীনতার জন্য একাত্তরে ভারতে হেঁটেছিল ১৪শ মাইল৷ তাদের কাছে ওটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধ৷ কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্বাধীন দেশে ৩৮ জন পদযাত্রীকে একনো মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি কিংবা কোন রাষ্ট্রীয় সম্মান দেয়া হয়নি৷
একাত্তরে ভারতে শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও কাজ করেছে৷ তারা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা ও নৃশংতার খবর তারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরাসহ ভলান্টিয়াদের মাধ্যমে শরণার্থী ক্যাম্পের যুবক-যুবতীদের সংগঠিত করে লেফট-রাইট করানো ও নানা কাজে যুক্ত রাখতো, যাতে কোনোভাবেই তারা বিপথগামী হয়ে না যায়৷একাত্তরে এ দুটো কাজই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷
তেমনি কাজ করেছিল ‘বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোর' নামের একটি সংগঠন৷এর উদ্যোক্তা ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম৷লন্ডনের ওয়ার অন ওয়ান্ট তাদের ফান্ড দিতো৷ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ ছিলেন ওয়ার অন ওয়ান্ট-এর চেয়ারম্যান৷এ সংগঠনেই ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন যুদ্ধ-আলোকচিত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ রায়হান৷তার বাড়ি কুষ্টিয়া শহরের ৫২ মসজিদ বাড়ি লেনে৷
বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরের দল যখন যে জায়গায় যেতো, তাদের সঙ্গেই যেতে হতো হামিদ রায়হানকে৷অক্টোবর থেকে বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়েও ছবি তুলছেন তিনি৷পাটগ্রামের মুক্ত এলাকা পরিদর্শন করতে এসেছিলেন ওয়ার অন ওয়ান্টের চেয়ারম্যান ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ৷ ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর ডোনাল্ড চেসওয়ার্থসহ পাটগ্রামের কোর্ট-কাচারি, হাসপাতাল ও বিভিন্ন জায়গায় ছবি তোলেন হামিদ রায়হান৷ এছাড়া তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্প, শরণার্থী ক্যাম্প ও মুক্তাঞ্চলগুলোয়৷পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ধ্বংস করা ব্রিজ, কালভার্ট ও ভবনের ছবিও উঠে এসেছে তাঁর ক্যামেরায়৷
শরনার্থী ক্যাম্পের বর্ণনা দিতে গিয়ে এই আলোকচিত্রী বলেন, "খুব কাছ থেকে দেখেছি কীভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে৷অভুক্ত অবস্থায় মানুষ আসছে দেশ (পূর্ব পাকিস্তান) থেকে৷তিন-চার দিন পর মিলে তাদের খাবার৷আবার কলেরা শুরু হয়ে গেল৷শরণার্থী ক্যাম্পগুলোয় চোখের একটা অসুখ দেখা দেয় তখন৷ চোখের ওই রোগ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল সব ক্যাম্পে৷ফলে পশ্চিম বাংলার লোকেরা ওই রোগের নাম দেয় ‘জয় বাংলা রোগ'৷ এক শরণার্থী ক্যাম্পে দেখেছি, মা মরে গেছে, বাচ্চা গিয়ে তার দুধ খাচ্ছে৷এই ছবিটা তুলতে না পারায় আজও খুব আফসোস হয়৷”
হামিদ রায়হান আরও বলেন, ‘‘একাত্তরে ভারতীয় জনগণের সহযোগিতার কথা না বললেই নয়৷ ভারতীয়রা ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া বাদ দিয়ে স্কুলগুলো দেয় শরণার্থীদের থাকার জন্য৷ ওই সময়ের শরণার্থী ক্যাম্পগুলো না দেখলে ঠিক বুঝতে পারবেন না, একাত্তরে কী হয়েছিল! ছবি তুলেছি বর্ডার এলাকার অ্যাকশন ক্যাম্পগুলোতেও৷ আমার ক্যামেরায় তুলে আনি একাত্তরের ৫৪০টির মতো ছবি৷ এই ছবিগুলোই বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরের মাধ্যমে বিশ্ব গণমাধ্যমে পাঠানো হতো৷ ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গড়তে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল৷''
রমজান মাসেও গণহত্যা
একাত্তরে অক্টোবরের শেষের দিকে শুরু হয় রমজান মাস৷পবিত্র কোরআনে রমজানকে রহমতের মাস বলা হয়৷কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় মুসলমান হয়েও পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসরেরা ওই মাসেও তাদের বর্বরোচিত গণহত্যা, নির্যাতন-নিপীড়ন, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ অব্যাহত রেখেছিল৷
২৫ অক্টোবর ছিল চতুর্থ রমজান৷ওইদিন টাঙ্গাইলের নাগরপুরের গয়াহাটা ইউনিয়নের বনগ্রামে লুটপাট-ধর্ষণ শেষে পৈশাচিক গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী৷ এ গণহত্যায় শহীদ হয় শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ নিরীহ ৫৭ জন গ্রামবাসী৷ পুড়িয়ে দেয়া হয় তাদের ১২৯টি বাড়িও৷
কুড়িগ্রামের রাজিবপুর থানার কোদালকাঠি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুর গ্রামে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় ওই একই তারিখে হামলা চালায় পাকিস্তানি সেনারা৷ এতে অর্ধশতাধিক গ্রামবাসী শহীদ হন৷সিলেটের গোপালগঞ্জ থানার পশ্চিম আমুড়া ইউনিয়নের সুন্দিশাইলেও পৈশাচিক গণহত্যা চালিয়ে ২৩ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে তারা৷ এমন গণহত্যা ও নির্যাতন চলে গোটা রমজান মাস জুড়েই৷ (তথ্যসূত্র: গণহত্যা'৭১-তপন কুমার দে, যুদ্ধ ও নারী-ডা. এম এ হাসান, স্বাধীনতা'৭১-বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম)
একাত্তরের অক্টোবর থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পিত আক্রমণ আরো তীব্রতর হতে থাকে৷সীমান্তবর্তী এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপগুলোর সরাসরি সশস্ত্র আক্রমণ এবং দেশের অভ্যন্তরে মানুষের সঙ্গে মিশে থাকা গেরিলাদের আক্রমণে দিশেহারা হতে থাকে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসরা৷একদিকে গেরিলা আক্রমণে সাবেক গভর্নরকে হত্যা অন্যদিকে আন্তজার্তিক চাপে চিন্তার ভাজ পড়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ললাটে৷