অধিকার সচেতনতা: ‘তবু কেন এমন একাকী?’
২৬ আগস্ট ২০২২আরও স্পষ্ট করে বললে, একে না এড়িয়ে আজকাল যেন আর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়৷ জীবনানন্দ দাশের কবিতা হিসেবে ‘বোধ’ আমাদের পাঠ্য হলেও, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এ বোধ যেন প্রায় অচ্ছুত হয়ে আছে৷ দিনকে দিন প্রায় ফিকে হতে চলেছে মানুষের বোধের সীমারেখাগুলো৷
অনেকে হয়ত বলবেন, এ হলো প্রযুক্তিগত শিল্প বিপ্লবের রূঢ় বাস্তবতা৷ কেউ কেউ হয়ত ইতিহাস মেনে জানাবেন, পৃথিবী যেদিন শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল, সেদিন থেকেই মানুষের বোধ নামক মানবিক প্রপঞ্চটি হারিয়ে গেছে৷ কিন্তু এ বিপর্যয় কি কেবলই মানবিক? আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত চৌহদ্দিতেও কি এ হারিয়ে যাবার প্রভাবটি স্পষ্ট নয়? আমাদের সংবিধান, পারিবারিক বা সামাজিক গণ্ডি, এমনকি আন্তর্জাতিক বিধি-বিধানেও কত রকমের ‘অধিকার’ ‘কর্তব্যের’ কথা প্রচলিত আছে- নাগরিক হিসেবে, পরিবারের সদস্য হিসেবে কিংবা পৃথিবীর সন্তান হিসেবে৷ আমরা যেন তা জেনেই খালাস৷ এর কিছু কিছু আমাদের পরীক্ষায় পাস করার কাজে লাগে বটে, কিন্তু জীবনের পরীক্ষায় এগুলোর কোনো বাস্তবায়ন আমরা ঘটাতে পারি না৷ অধিকার নিয়ে আমাদের সভা-সেমিনার হয়, মিছিল-মিটিং, আন্দোলন-সংগ্রাম হয়; কিন্তু কার অধিকার? যার জন্য এ আন্দোলন, যাদের অধিকারের জন্য এ সংগ্রাম-সভা-সেমিনার, তারা কি আদৌ বিষয়টি অবগত? বা আমরা যারা আন্দোলনকর্মী; কিংবা ধরা যাক, সমাজ যাদেরকে তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছে, তারাও কি নিজেদের অধিকার সম্পর্কে ঠিকঠাক জানি? নাকি কম্পিউটার বা মোবাইলে কোনো সফটওয়্যার ইনস্টল করার সময় বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো একাউন্ট খোলার সময় যেমন ‘টার্মস এন্ড কন্ডিশনে’ কেবল ‘আই এগ্রি' বলে একটি টিকমার্ক দিয়ে যাই, তেমনই ঘটে আমাদের অধিকারবোধের বেলায়৷ ফলে ‘অধিকার' কথাটি আজ যেন সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোর ওই শর্তাবলীর মতোন; আছে জানি- কিন্তু কেন আছে, থাকলে তার ব্যবহার কী, আমি দ্বিমত করলে তখন কী হবে বা সে শর্ত লঙ্ঘনে আমার করণীয় কি- তার কোনো হদিশ নেই৷ ফলে সবকিছুই যেন খানিকটা কেতাবি কায়দায় আমাদের সামনে আসে৷ নিষ্ঠুর বাস্তবতার সামনে দাঁড়ালেও অনেকটা কেতাবি কায়দাতেই আমরা তার সমাধান করার চেষ্টা করি৷ তাতে সমাধান যে হয় না, তা কিন্তু নয়৷ কিন্তু সমস্যার গোড়াটা বোধ করি থেকেই যায়, যেখান থেকে নতুন রূপে আবার সমস্যাটি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে৷
এ কারণেই অধিকার ‘আদায়’ কথাটি আমাদের গার্হস্থ্য ও পৌরণীতিতে যতটা উচ্চকিত, অধিকার ‘সচেতনতা’ ততটা নয়৷ আমার মতে, এ না থাকার কারণটি হলো, মানুষের স্বার্থবাদী মনোবৃত্তি৷ অধিকার আদায় অনেকটাই উত্তম পুরুষের দায়, অর্থাৎ যে অধিকারের কথা বলা হচ্ছে, তা থেকে আমিও বঞ্চিত বা বঞ্চিত হবার সম্ভাবনা আমারও আছে৷ কিন্তু অধিকার সচেতনতা উত্তম বা মধ্যম পুরুষের দায় নয়, এটি একটি সামগ্রিক দায়৷ একজন অধিকার সচেতন ব্যক্তি পৃথিবীর সকল প্রাণীর অধিকারের প্রসঙ্গে সচেতন থাকবেন৷ এ কারণেই এ বোধ আদায় নয়; বরং অর্জন করতে হয়৷ অর্জনের এ বৃহৎ বৃত্তে ব্যক্তির নিজের অধিকারটুকুও রক্ষিত হবে, সন্দেহ নেই৷ ফলে অধিকার আদায় কথাটির যেমন একটি রাজনৈতিক আবেদন আছে, অধিকার সচেতনতা কথাটিরও তেমনি একটি তাত্ত্বিক আবেদন আছে৷ অধিকার সচেতনতা থাকলে অধিকার আদায়ের রাজনীতির কোনো দরকার পড়ে কি? আমার তো মনে হয় না৷
ফলে আন্দোলন-সংগ্রাম বা আইনি প্রক্রিয়ায় অধিকার আদায় করা যতটা সহজ, অধিকার সচেতনতা অর্জন ততটা সহজ নয়৷ চাইলেই আন্তর্জাতিক আদালতে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে একটি আইনি বা প্রতীকী সমাধান বের করা যায়; কিন্তু সভ্যতার পরাকাষ্ঠা হিসেবে পরিচিত ব্রিটিশরা কীভাবে গোটা পৃথিবীতে উপনিবেশবাদের শাসন চালিয়েছিল- তার উত্তর সহজে পাওয়া যাবে না৷ বাংলাদেশের চা শ্রমিকগণ দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির জন্য আন্দোলন করছেন, আমার বিশ্বাস- এ সংবাদটি প্রকাশিত হবার পরই হয়ত অনেকে প্রথমবার জেনেছেন, আমাদের চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ছিল ১২০ টাকা৷ অথচ চা আমাদের দৈনন্দিন অনুষঙ্গ৷ বাংলাদেশের অনেকেরই চা-বাগানে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা আছে৷ সাহিত্য, আলোকচিত্র বা ডকুমেন্টারিও হয়ত হয়েছে বিভিন্ন চা-বাগানের ওপর৷ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে এই চা খেতে খেতেই হয়ত নানা নতুন দিক তৈরি হয়েছে৷ অথচ আজকের এ উচ্চমূল্যের বাজারেও চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা! এ সত্যটি আমরা জানলাম কখন, যখন শ্রমিকরা আন্দোলনে নামলেন, যখন কাজ বন্ধ করে দিলেন, অর্থাৎ যখন দেয়ালে তাঁদের পিঠ ঠেকে গিয়েছে৷ আজ এ ন্যায্য আন্দোলনের সঙ্গে আমরা অনেকেই সংহতি জানিয়েছি৷ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এ চা-শ্রমিকদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন৷
তাহলে কি নিজে থেকে আওয়াজ না তুললে আমার পাশে কেউ দাঁড়াবে না? আমার স্পষ্ট উত্তর হচ্ছে- না, দাঁড়াবে না, এমনকি ন্যায্য হলেও দাঁড়াবে না৷ কিছুটা রূঢ় শোনালেও আমার এ উত্তরটি অন্তত আমার অভিজ্ঞতার আলোকে ঠিক বলেই মনে করছি৷ অধিকারহীনতার সিংহভাগ দায়, অধিকার সচেতনতার অভাব৷ সেটা ব্যক্তি পর্যায়েও হতে পারে আবার রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও হতে পারে৷ আগেও বলেছি, অধিকার সচেতনতা একটি সামগ্রিক বিষয়৷ এটা থাকলে আলাদা করে অধিকার আদায়ের জন্য তৎপর হতে হয় না৷ এখন যারা অধিকার হরণ করে, সে রাষ্ট্রই হোক বা সমাজই হোক, সে ওই অধিকার সচেতনতার যে শূন্যতা, তার সুযোগই গ্রহণ করে৷ অনেকক্ষেত্রেই দেখেছি, কোনো নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে সোচ্চার হয়েছেন৷ আমরাও সাধ্যমতো তার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি৷ কিন্তু হঠাৎ করে তিনি মত পরিবর্তন করলেন৷ নির্যাতনকারীর চেয়েও তার কাছে মুখ্য হয়ে ওঠল তার সঙ্গে ওই নারীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক৷ অর্থাৎ হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো তার মধ্যে যে অধিকার সচেতনতার বোধটুকু জন্মেছিল, সেটা সাময়িক, তা থেকে কোনো সমাধান সম্ভব নয়৷ আবার যে নির্যাতনকারী, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, প্রাত্যহিক জীবনের কোথাও না কোথাও তারও কিছু অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, সে বিষয়ে সে সোচ্চার; অথচ নিজের ঘরেই সে কিন্তু একজন নির্যাতনকারী এবং অন্যের অধিকার হরণ করছে প্রতিনিয়ত৷
অধিকার কেবল ব্যক্তিগত হয় না, কেবল নিজেরটুকু বুঝলেই হয় না- এ সত্যটুকু আজও আমরা বুঝতে পারিনি৷ বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে অনেকগুলো নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে৷ খাতা-কলম নিয়ে হিসেবে বসলে দেখা যাবে, তার মধ্যে বেশ কিছুর বিচারও হয়েছে৷ কোনো কোনো নারী নির্যাতনের বিচারের জন্য সার্বিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও হয়েছে৷ কিন্তু নারী নির্যাতনের ঘটনা আজও ঘটে চলেছে৷ কারণ, বিচার অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারে মাত্র, অপরাধ মনোবৃত্তিকে দমন করতে পারে না৷ তাই বলে বিচারের ভূমিকাও কম নয়৷ সুষ্ঠু বিচার হলে অপরাধীর মধ্যে একটি ভয়ও তৈরি হয়, আর এজন্যই আইনের শাসন জরুরি৷
অধিকার না থাকা আর অধিকার সচেতনতা না থাকা- দুটো ভিন্ন জিনিস৷ অধিকার না থাকলে তা আদায়ে সোচ্চার হওয়া যায়; কিন্তু অধিকার সচেতনতা না থাকলে অধিকারহরণের বোধটুকুও জন্মায় না৷ অন্যদিকে অধিকার সচেতনতার অভাবে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে পড়ে একচোখা৷ কারণ, ওই শূন্যস্থানটুকু তো আর খালি থাকে না৷ পারিপার্শ্বিক নানা মত-পথ-বোধ-রাজনীতি সেখানে ঠাসাঠাসি করে জায়গা করে নেয়৷ ফলে ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে পড়ে প্রশ্নাকীর্ণ৷ নরসিংদীর রেলস্টেশনে একজন নারী তার পছন্দমতো পোশাক পরেছিলেন বলে হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন৷ এ নিয়ে আন্দোলন হয়েছে, আদালতে আইনজীবী উদ্ভট বক্তৃতা দিয়েছে এবং শেষপর্যন্ত উচ্চ আদালত নির্যাতনকারীর জামিন স্থগিত করেছে৷সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এ ঘটনায় যারা সেই নির্যাতনকারীর পক্ষে কথা বলেছিল বা এখনও বলছে, তারাই কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকায় কোনো হিজাব পরিহিত নারী একইধরনের হেনস্তার শিকার হলে উল্টো কথা বলেন৷ এই যে তাদের একচোখা রায়, এটা মূলত তাদের নিজ নিজ অধিকার সচেতনতার অভাব৷ তারা যদি সহজ করে একটি সত্য মেনে নিতেন (বা নিজের জীবনেও চর্চা করতেন) যে, পোশাক একজন ব্যক্তির নিজস্ব অভিরুচি ও আরামের বিষয়৷ তিনি কী পরবেন, কীভাবে পরবেন সেটা একান্তই তার অভিরুচি৷ এখানে অন্য কোনো প্রসঙ্গ টেনে আনা বাতুলতা মাত্র৷ এ সহজ সত্যটুকু মেনে নিলে পৃথিবীর কোথাও পোশাকের জন্য কোনো মানুষকেই হেনস্তার শিকার হতে হতো না৷ কিন্তু এ সত্য কি আমরা মানছি? মানছি না বলেই একের পর এ ধরনের ঘটনা ঘটছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে৷ আমরা পথে বা ইন্টারনেটে তার আন্দোলন করছি, কিছুদিন আলাপ-আলোচনা-হ্যাশট্যাগ হচ্ছে- তারপর যেই কে সেই৷
অধিকার সচেতনতার এ অভাবের সর্বোচ্চ সুযোগ যেমন নেয় রাষ্ট্র বা সমাজ, তেমনি এর সর্বোচ্চ শিকারও হয় এ দুটো প্রতিষ্ঠানই৷ বাংলাদেশের সংবিধান মতে, প্রজাতন্ত্রের কাজে নিযুক্ত সকলেই হবেন ‘কর্মচারী’৷ কিন্তু দাপ্তরিক পরিচয় থেকে সংবাদপত্র- সবখানেই ‘কর্মকর্তা’ ও ‘কর্মচারী’ দুটো আলাদা শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে৷ কেউ কোনো প্রতিবাদ করছেন না, রাষ্ট্রেরও কোনো মাথাব্যথা নেই! এ যে সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, তা যেন বিবেচ্যই নয়৷ এখন ইতিহাস থেকে তো আমরা জানিই, প্রশাসনের এই ‘বড়ো সাহেবরা' রাষ্ট্রকে বহুবার অবৈধ সামরিক শাসকদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন৷ সেদিন রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দাবি ক্ষুণ্ন হয়েছিল বটে, কিন্তু এ জন্য রাষ্ট্রও কি দায়ী নয়?
এমন অনেক উদাহরণই হয়ত দেয়া যাবে; কিন্তু দিনশেষে কোনো সুস্পষ্ট সমাধানে আমরা পৌঁছুতে পারব কি? কাঙ্ক্ষিত সে লক্ষ্যে পৌঁছুতে হলে আমাদের নিজেদের মধ্যে অধিকার সচেতনতার বোধ তৈরি করা জরুরি৷ অর্থাৎ অধিকারের বিষয়টি সার্বজনীন হতে হবে এবং এটা যৌক্তিকভাবেই ব্যক্তিকে স্বীকার করতে হবে৷ আমার যেটা অধিকার, সেটা অন্যেরও অধিকার৷ আমার যদি খাদ্য-বাসস্থানের অধিকার থাকে, তবে সেটা পৃথিবীর অন্য প্রাণীদেরও আছে৷ আমার বাড়ি গুঁড়িয়ে দিলে সেটা যেমন অধিকার লঙ্ঘন, তেমনি আমি বন বা নদীর জমি দখল করে বাড়ি বানালে, সেটাও অধিকার লঙ্ঘন৷ এ বোধটুকু যতক্ষণ না জন্মাবে, ততক্ষণ কোথাও না কোথাও প্রাণের অধিকার লঙ্ঘিত হবেই৷ মানবজাতির ইতিহাসে যে গৌরবগাথা আমরা রচনা করে চলেছি, অধিকারলঙ্ঘনের পাপে তা কলুষিত হবেই৷ তখন লজ্জায় মুখ ঢাকার উপায় থাকবে না৷