অধীর না খাড়গে, কার পথে চলবে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস?
১৫ জুন ২০২৪সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে জোট বেধে লড়েছিল বাম ও কংগ্রেস। বামেরা ৪০ ও কংগ্রেস ১২টি আসনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। যদিও কোচবিহার ও পুরুলিয়া কেন্দ্রে বোঝাপড়া ফলপ্রসূ হয়নি। মালদা দক্ষিণে ইশা খান চৌধুরী ছাড়া এই জোটের কোনো প্রার্থী নির্বাচনে জিততে পারেননি।
অধীরের হারের জের
ইশার জয়ের থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর পরাজয়। মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কেন্দ্রে সাবেক ক্রিকেট তারকা ইউসুফ পাঠানের বিরুদ্ধে হেরে যান পাঁচবারের সাংসদ অধীর। এর পরই পশ্চিমবঙ্গে অধীর চৌধুরীর রাজনৈতিক লাইন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গিয়েছে।
অধীর বরাবরই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোর বিরোধী। তৃণমূলের সঙ্গে কোনো বোঝাপড়ায় যেতে তিনি রাজি নন। ইন্ডিয়া জোট তৈরির পর পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ও তৃণমূলের আসন সমঝোতা নিয়ে একটা জল্পনা হাওয়ায় ভাসছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেন অধীর।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী দিল্লিতে ডেকে প্রদেশ নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সেখানেই অধীরের নেতৃত্বে প্রদেশ নেতারা জানিয়ে দেন, তৃণমূলের সঙ্গে কোনো সমঝোতা করতে তারা প্রস্তুত নন। বরং বামেদের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই চলতে চান তারা। মমতা প্রকাশ্যে বার্তা দিয়েছিলেন, তিনি দুটি আসন কংগ্রেসকে ছাড়তে পারেন। যদিও এ নিয়ে আলোচনার সুযোগই আসেনি।
নির্বাচনে কংগ্রেস ও বাম নেতৃত্ব একযোগে তৃণমূল সরকারকে আক্রমণ করেছে। রাজ্যে বিভিন্ন দুর্নীতি থেকে গণতন্ত্রহীনতার অভিযোগ তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানা করেছেন অধীর। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের সঙ্গে জুটি বেধে নির্বাচনে লড়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। কিন্তু ভোটে তৃণমূলের বিপুল জয় অধীরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। একইভাবে প্রশ্নের মুখে বঙ্গের জাতীয় কংগ্রেসের ভবিষ্যৎও।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কংগ্রেসে ছিলেন, সেই সময় তিনি প্রদেশ নেতৃত্বের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতেন। যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী হিসেবে কার্যত সমান্তরাল সংগঠন পরিচালনা করতেন মমতা। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন তিনি। তখনই কংগ্রেসের একটা বড় অংশ তৃণমূলে যোগ দেয়। এরপরের ইতিহাস কংগ্রেসের ক্ষয় ও তৃণমূলের বৃদ্ধির।
তৃণমূলে নরম হাইকমান্ড
তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রদেশ নেতারা খড়্গহস্ত হলেও কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অনেকটাই নরম। ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে রাহুলের পাশেই দেখা গিয়েছে মমতাকে। এআইসিসি নেতারা বারবার তৃণমূল নেত্রীর উদ্দেশে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছেন। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়গে, কেন্দ্রীয় নেতা জয়রাম রমেশ, কে সি বেণুগোপাল তৃণমূলের সঙ্গে আসন সমঝোতা বা জোট করার কথাই বলেছেন বারবার।
প্রদেশ নেতৃত্বের অবস্থান নিয়ে কড়া মন্তব্য করতে শোনা গিয়েছে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতাদের। অধীরের উদ্দেশে নাম না করে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন খড়গে। বিভিন্ন ইস্যুতে তৃণমূল কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়েছেন পবন খেরার মতো কেন্দ্রীয় নেতারা। কিন্তু কোনো কিছুই অধীরের দৃঢ় অবস্থান বদলাতে পারেনি।
কংগ্রেসের প্রথম সারির কেন্দ্রীয় নেতারা আইনি পরামর্শদাতা হিসেবেও তৃণমূলের পাশে দাঁড়িয়েছেন। একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে। এই সংক্রান্ত মামলা যখন সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছেছে, তখন তৃণমূলের পক্ষে সওয়াল করেছেন কয়েকজন দুঁদে আইনজীবী। এদের মধ্যে রয়েছেন কংগ্রেস নেতা ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কপিল সিব্বল, কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভি।
এই নিয়েও প্রদেশ নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন। কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী ও সাবেক কংগ্রেস নেতা কৌস্তভ বাগচী বারবার সরব হয়েছেন সিব্বল, সিংভিদের বিরুদ্ধে। এই কৌস্তভকে রাজ্য পুলিশ পাকড়াও করেছিল। যদিও তিনি জামিন পেয়ে যান। পরে কৌস্তভ যোগ দেন বিজেপিতে। তার মতে, "প্রদেশ কংগ্রেসে থেকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ঠিকঠাক লড়াই করা যাচ্ছে না। হাইকমান্ড লড়াই চায় না।"
গত লোকসভায় অধীর ছিলেন কংগ্রেসের দলনেতা। এবার আর তিনি সংসদে যেতে পারেননি। তার উপর কংগ্রেস ও বাম জোট মাত্র একটি আসনে জিতেছে। এতে দুর্বল হয়েছে অধীরের অবস্থান। কিন্তু তার যুক্তি দুর্বল হয়নি বলে মত প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির। তিনি বলেন, "সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ভোট হয়েছে। সেই কারণে আমরা পরাজিত হয়েছি। কিন্তু তৃণমূল ও বিজেপির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চলবে।"
পর্যবেক্ষক ও অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী বলেন, "তৃণমূল বহরমপুরে একটা চালাকি করেছে। জাতীয় স্তরের সংখ্যালঘু আইকন পাঠানকে তারা তুলে এনেছে। যে সংখ্যালঘুরা অধীরের পাশে থাকতেন, তারা গুরুত্ব দিয়েছেন তাদের জাতিসত্তাকে। তবে সার্বিকভাবে কংগ্রেস মালদহ ও মুর্শিদাবাদের বাইরে কোনো জেলায় তেমন প্রাসঙ্গিক নয়। তাদের ভাবনা মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারছে না৷’’
সমন্বয়ের অভাব
এবার অধীরের হারের পিছনে প্রদেশ ও কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতাদের সমন্বয়ের অভাবকেও অনেকে দায়ী করছেন। অধীরের পক্ষে প্রচারে আসেননি কোনো কেন্দ্রীয় নেতা। নির্বাচনী কেন্দ্রে খরচের জন্য যে তহবিল দিল্লি থেকে পাওয়া যায়, সেটাও এসেছে ভোটের পরে।
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভময় মৈত্র বলেন, "অধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে তৃণমূল প্রার্থী দিয়েছিল। আবার কেন্দ্রীয় কংগ্রেস বরাবরই তৃণমূলের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের একটা দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি অনেক জায়গাতেই ছিল। কেন্দ্র ও রাজ্যের কংগ্রেসের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। এটা অধীরের পরাজয়ের ক্ষেত্রে একটা কারণ বলা যেতেই পারে।"
ভবিষ্যতে লড়াই কীভাবে চলবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। আর দুই বছরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন। সেই ভোটে বাম ও কংগ্রেস কি আবার হাত ধরাধরি করে লড়বে? নাকি ভোটে হেরে যাওয়া অধীরের উপর চাপ তৈরি হবে তৃণমূলকে মেনে নেওয়ার জন্য?
২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ থাকবে বিজেপি। তাদের রুখতে কি তৃণমূল ও কংগ্রেস হাত মেলাবে হাইকমান্ডের ইচ্ছায়?
লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বিরোধী জোট আশাতীত সাফল্য পাওয়ায় তাদের মধ্যে বোঝাপড়া দৃঢ় হয়েছে। ফল প্রকাশের পর ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আগামী দিনগুলিতে এই জোট আরও নিবিড় ভাবে কাজ করবে বলে সব পক্ষই আশা প্রকাশ করেছেন।
ভবিষ্যতের দিশা
পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি লোকসভার অধীনে ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের হিসেবে দেখা যাচ্ছে মোট ১২টি বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে রয়েছে বাম ও কংগ্রেস জোট। এর মধ্যে বামেরা মাত্র একটি কেন্দ্রে লিড পেয়েছে।
বাম-কংগ্রেস জোট ও তৃণমূলের মধ্যে ভোট কাটাকাটি হওয়ায় রায়গঞ্জ কিংবা মালদহ উত্তরে বিজেপি জিতে গিয়েছে। আবার কয়েকটি কেন্দ্রে জোট প্রার্থীর উপস্থিতি বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলের জয়কে সহজ করে দিয়েছে। কংগ্রেস ও তৃণমূলের জোট বিজেপির ক্ষমতা এই রাজ্যে আরো কমিয়ে আনতে পারে, এমন ইঙ্গিত পরিসংখ্যানে রয়েছে।
রাজ্য ও জাতীয় রাজনীতির এমন পরিস্থিতি এবং অধীরের পরাজয় একটা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, আর কতদিন প্রদেশ কংগ্রেস তৃণমূলকে অচ্ছুত করে রাখতে পারবে? যদিও অধীর এখনো তৃণমূল বিরোধিতায় অনড়। তিনি বামেদের সঙ্গে সমঝোতা অটুট রাখার পক্ষপাতী। যদিও জোট থাকলেও তার সাফল্য নিয়ে আশাবাদী নন পর্যবেক্ষকদের একাংশ।
পর্যবেক্ষক মইদুল ইসলাম বলেন, ''পশ্চিমবঙ্গে বহুমুখী থেকে দ্বিমুখী লড়াইয়ের প্রবণতা বেশি থাকে। বিজেপি টিকে থাকবে, না কি তাদের ভোট বামেরা ফিরিয়ে নিতে পারবে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে যেহেতু একই রাজ্যে দুটি ক্যাডার ভিত্তিক দল থাকতে পারে না। তবে দুই বছর পর বিধানসভা ভোটে সমীকরণ কী দাঁড়াবে, সেটা এখনই বলা যাবে না।"