অনার কিলিং: পরিবারের সম্মানের নামে হত্যা
পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে প্রতি বছর সারা বিশ্বে কত কিশোরী, তরুণী ও মহিলাকে অংশত শারীরিক নির্যাতনের পর নির্মম নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই৷ সংখ্যাটা ৫,০০০ থেকে ২০,০০০ পর্যন্ত হতে পারে৷
প্রতিবছর কতজন অনার কিলিংয়ের শিকার?
২০০০ সাল থেকে বিক্ষিপ্তভাবে সংগৃহীত ও প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা বিশ্বে বছরে প্রায় ৫,০০০ অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে থাকে৷ এই সংখ্যা জাতিসংঘের বিবৃতির সঙ্গেও মেলে৷ যেহেতু বহু অনার কিলিংয়ের ঘটনাকে দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়, সেহেতু বাস্তব পরিসংখ্যান এর চারগুণ হলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই৷
যাদের হত্যা করা হয়
পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে যাদের হত্যা করা হয়, তাদের গড় বয়স ২৩ ও তাদের ৯৩ শতাংশই মেয়ে৷ দুই-তৃতীয়াংশ প্রাণ হারায় পরিবারের সদস্যদের হাতে৷ নিহতদের অর্ধেক হত্যাকারীর মেয়ে, নয়তো বোন; নিহতদের এক চতুর্থাংশ হত্যাকারীর স্ত্রী কিংবা বান্ধবী৷ হত্যার কারণ ষাট ভাগ ক্ষেত্রে ‘বড় বেশি পশ্চিমি’ হয়ে পড়া; বাকিদের ক্ষেত্রে পুরুষ বা পরপুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর অভিযোগ৷
পাকিস্তান: ইজ্জতের নামে হত্যা
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৫ সালে পাকিস্তানে প্রায় ১,১০০ অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে৷ পাকিস্তানের গ্রামীণ সমাজে অনার কিলিংয়ের প্রতি জনসাধারণেরও সমর্থন থাকার ফলে, এই কুপ্রথা দূর করার যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যহত হয়েছে ও হচ্ছে৷ ইতিপূর্বে নিহতের পরিবার হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিলে সে ছাড় পেতো; এ’বছর আইনের সে ফাঁকটি বন্ধ করা হয়েছে৷
সোশ্যাল মিডিয়া স্টার কান্দিল বেলুচের হত্যা
২০১৩ সালে পাকিস্তানি আইডলের জন্য অডিশন করার পর থেকেই এই পাকিস্তানি তরুণী একজন ইন্টারনেট সেলিব্রিটি হয়ে পড়েছিলেন৷ ২০১৬ সালের ১৫ই জুলাই কান্দিলকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে তাঁর নিজের ভাই ওয়াসিম আজিম৷ আজিম বোনকে খুন করার কথা স্বীকার করে বলেছে, পরিবারের ‘ইজ্জতের’ উপর ‘দুর্নাম’ আনছিলেন কান্দিল, তাই...৷
পাথর ছুঁড়ে হত্যা
২০১৪ সালের ২৭শে মে৷ পাকিস্তানের লাহোর শহরে পুলিশ মর্গের সামনে অ্যাম্বুলেন্সে শোয়ানো ফারজানা ইকবালের মৃতদেহকে ঘিরে কাঁদছেন প্রবীণারা৷ প্রেমিককে বিয়ে করার দোষে লাহোর হাইকোর্টের সামনে পাথর ছুঁড়ে ফারজানাকে হত্যা করে তাঁর পরিবারের সদস্যরা৷
ভারতে অনার কিলিং
গোটা দেশে বছরে হাজার খানেক অনার কিলিং হয় বলে অনুমান করা হয়ে থাকে, যদিও বাস্তবিক সংখ্যা জানা সম্ভব নয়৷ উত্তর ভারতে, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ ও হরিয়ানাতেই অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে বেশি, দক্ষিণ ভারত বা মহারাষ্ট্র কিংবা গুজরাটে সে তুলনায় কম৷ অনার কিলিংয়ের খবর পাওয়া গেছে পাঞ্জাব ও বিহার থেকেও৷ পশ্চিমবঙ্গে অনার কিলিং গত একশ’ বছর ধরেই প্রায় নেই বললেই চলে৷
‘বাংলাদেশে অনার কিলিং মানসিকতায়’
বাংলাদেশে অনার কিলিংয়ের খবর এখনো পাওয়া যায়নি৷ তবে পরিবারের পছন্দে বিয়ে না করার কারণে হত্যার ঘটনা বেশ কিছু ঘটেছে৷ তাই জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেছেনন, ‘‘অনার কিলিংয়ের মানসিক অবস্থা এখানে (বাংলাদেশে) বিদ্যমান৷ পাকিস্তানের মতো এখানে এটা প্রকট নয়৷ তবে যা হচ্ছে তা ব্যক্তি ও পরিবারের অহংবোধ থেকে৷ এখানে সমস্যাটি হলো ধনী-গরীবের ব্যবধান নিয়ে৷''
অন্য দেশে...
ব্রিটেনে অভিবাসীদের মধ্যে অনার কিলিং বিরল নয়৷ কুর্দি, পাকিস্তানি ও সিরীয় বাবারা নিজেদের মেয়েদের স্বহস্তে হত্যা করছেন, এমন ঘটনা বারংবার ঘটেছে৷ ২০১০ সালে এক শিখ পিতা তাঁর কন্যাকে হত্যা করেন৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষিপ্ত হলেও, অভিবাসী সম্প্রদায়গুলির মধ্যে একাধিক অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে৷ জার্মানি ও ইউরোপের অন্য কয়েকটি দেশেও অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে৷
ক্যানাডায় আফগান বাবার হাতে তিন মেয়ে খুন
ঘটনাটা আলোড়ন তুলেছিল ২০০৯ সালে৷ সে বছর ক্যানাডার অন্টারিও প্রদেশের কিংস্টন শহরের খালে একটি গাড়ি ডুবন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়৷ গাড়িতে ছিল ১৯, ১৭ ও ১৩ বছর বয়সের তিনটি মেয়ে ও তাদের মায়ের লাশ৷ ২০১২ সালের ছবিতে (ওপরে) মেয়ে তিনটির বাবা মোহম্মদ শাফিয়া, তাঁর স্ত্রী তুবা মোহম্মদ ইয়াহিয়া ও পুত্র হামেদকে কিংস্টন আদালতে পৌঁছতে দেখা যাচ্ছে৷
বার্লিনে হাতুন সুরুচু হত্যাকাণ্ড
হাতুন সুরুচু ছিলেন তুরস্কের আনাতোলিয়া থেকে জার্মানিতে আসা এক কুর্দ দম্পতির সন্তান৷ বার্লিনের তুর্কি-অধ্যুষিত ক্রয়েৎসব্যার্গ অঞ্চলে মানুষ হয়েছেন৷ ১৬ বছর বয়সে তাঁকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় তুরস্কে৷ জার্মানিতে ফিরে হাতুন পুত্রসন্তানের জন্ম দেন ও স্বাধীন জীবন যাপন শুরু করেন৷ একটি কলহের পর হাতুনকে বার্লিনের এক বাস স্টপে মাথায় তিনবার গুলি করে মারেন তাঁর ভাই আইহান সুরুচু৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে সেই বাস স্টপ৷