মরণোত্তর অঙ্গদান
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫এলমার স্প্রিংক-এর শখ ছিল সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো, জগিং করা৷ খেলাধুলাই এলমার-এর সবকিছু৷ কিন্তু আচমকা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে গেলো৷ জানা গেলো, হৃদযন্ত্রটি বেশ দুর্বল৷ বাঁচতে হলে চাই নতুন হৃদযন্ত্র৷ তারপর বিশেষ হাসপাতালে অপেক্ষার পালা৷ কে দান করবে হৃদযন্ত্র? এদিকে শরীরের অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে৷
সেই ভয়ংকর সময়ের দিকে ফিরে তাকালে এলমার বলেন, ‘‘এখন ফিরে তাকালে ভাবা যায় না, কীভাবে সব হলো৷ আমি সব সময় বলতাম, মরতে হলে হাসতে হাসতে মরবো৷ এ অবস্থায় অন্য কিছুই মানায় না৷ তখন সবাই আমাকে আশা দিচ্ছিল৷ বলছিল, একদিন সঠিক হৃদযন্ত্র পাওয়া যাবে৷ কবে, তা কেউ জানতো না৷ দু'মাস লাগতে পারে, ছয় মাসও লাগতে পারে৷ তবে একবার অপারেশন হলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা ৯৭ বা ৯৮ শতাংশ৷ শুনে মনে হলো, আমিও হয়ত পারবো৷ তারপর আমার শরীর সেই নতুন অঙ্গ মেনে নেবে কি না, সেটা দেখতে হবে৷''
প্রায় ১৮০ দিন শয্যাশায়ী থেকে অবশেষে এলমার নতুন হৃদযন্ত্র পেলেন৷ পেলেন এক নতুন জীবন৷ প্রায় ১০ মাস আগে নিজের বাসায় ফিরে গেছেন৷ ফিরেই কয়েক দিন পর শুরু হয়ে গেছে খেলাধুলা৷ স্ত্রী কারিন বলেন, ‘‘আসল কথা হলো, এলমার যাতে তার পুরনো জীবন ফিরে পায়৷ সে খেলাধুলা করতে খুব ভালোবাসে৷ সেটাই তার চরিত্র৷ আমার মনে হয়, সেটা আবার করতে পারলেই সে খুব আনন্দ পাবে৷''
সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা – সারা জীবন ধরে এলমার-কে ইমিউন সাপ্রেসিভ ড্রাগ খেতে হবে৷ শরীর যাতে নতুন অঙ্গ বাতিল না করে দেয়, তার জন্যই এই ট্যাবলেট৷ তবে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের আগের জীবনে এলমার কোনোদিনই ফেরত যেতে পারবেন না৷ এলমার বলেন, ‘‘যেমন অনেকক্ষণ বসে থাকলে বুকে, বুকের কাটা অংশে সমস্যা হয়৷ এটা একেবারেই ভালো নয়৷ শরীরের উপর চাপ এলে সমস্যা নেই৷ কিন্তু মন-মেজাজের উপর চাপ এলেই মুশকিল৷ আগের মতো আর সামলাতে পারি না৷ স্ট্রেস হলেই আজকাল সেটা বুঝতে পারি৷ ছোটখাটো ঝগড়াঝাঁটি হলেও তা সহজে মেনে নিতে পারি না৷''
মাসে তিন বার এলমার-কে হার্ট স্পেশালিস্টের কাছে ছুটতে হয়৷ তিনি পরীক্ষা করে দেখেন, শরীর নতুন অঙ্গকে কতটা মেনে নিয়েছে, শরীরের স্ট্যামিনা বা শক্তি কতটা বাড়ছে৷ কার্ডিয়োলজিস্ট ক্রিস্টিয়ান শ্নাইডার বলেন, ‘‘আমার অনেক পেশেন্ট রয়েছে, যাদের বয়স এলমার-এর চেয়ে অনেক কম৷ এলমার যা পারছে, তারাও সেটা পারে না৷ সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত কোলোন ক্যাথিড্র্যালের উপরে ওঠার মতো ক্ষমতা এখন তার আছে৷ অথচ আগে সে দোতলায়ই উঠতে পারতো না৷''
এলমার-এর ভাগ্য ভালো ছিল৷ কারণ জার্মানিতে মৃত্যুর পর অঙ্গদান করার লোক কমে চলেছে৷ ফলে অঙ্গদানও আর তেমন হচ্ছে না৷ ডা. শ্নাইডার বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, অনেক মানুষই নিজেদের মৃত্যু নিয়ে ভাবতে প্রস্তুত নয়৷ এমনকি রোগব্যাধি নিয়েও নয়৷ মৃত্যুর সময়টা কেমন হয়, আমার ক্ষেত্রে সেটা কেমন হবে – শেষের দিনগুলি সম্পর্কে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলি চাপা থাকে৷ তারা বলে, ‘‘মৃত্যু তো বয়স্ক লোকেদের ব্যাপার৷ আমার এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই৷ মৃত্যুর পর আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে কী হবে, তা নিয়ে তো ভাবতেই চাই না৷'' উল্লেখ্য, প্রয়োজনীয় অঙ্গের অভাবে শুধু গত বছরই জার্মানিতে ১,০০০-এরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷
এলমার এই অবস্থা বদলাতে চান৷ বন্ধুদের সাথে তিনি মরণোত্তর অঙ্গদানের বিষয়ে প্রচার চালাতে চান৷ খেলাধুলাই সেই কাজে সাহায্য করতে পারে৷ এলমার বলতে চান, ‘‘তোমরা দেখো, অন্যের থেকে পাওয়া অঙ্গ নিয়েও কী ভালোভাবে বাঁচা যায়৷'' আজ এলমার ১০ কিলোমিটার ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিতে পারেন৷ এলমার স্প্রিংক বলেন, ‘‘মনে হয়, যিনি আমাকে অঙ্গ দিয়েছেন, তিনি যেন আমাকে দেখতে পাচ্ছেন৷ আমি চাই, তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, ভালো থাকুন৷ তাঁকে চিনি না বটে, কিন্তু বার বার আমার মন ছুঁয়ে যান তিনি৷ প্রতিটি দিনই তাঁর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ বোধ করি৷ খেলাধুলা করলেই সেটা আমার মনে হয়৷''
থামার পাত্র নন এলমার৷ ম্যারাথনের পর সাইকেল-রেস, ট্রায়াথলন ও পাহাড়ে চড়ার তোড়জোড় করছেন তিনি৷ তাঁর নতুন এই জীবন সবে এক বছর পূ্র্ণ হয়েছে৷
এসবি/ডিজি