অবশেষে প্রতিবাদে বুদ্ধিজীবীরা
২১ জুন ২০১৩বিশিষ্ট কবি-প্রাবন্ধিক শঙ্খ ঘোষ, প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র, সাহিত্যিক দেবেশ রায়, সমরেশ মজুমদার, নাট্য ব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, অশোক মুখোপাধ্যায়, সুমন মুখোপাধ্যায়, নাট্যকার চন্দন সেন, বর্ষীয়ান চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার, অভিনেতা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী, চন্দন সেন, বাদশা মৈত্র, দেবদূত ঘোষ – নামের তালিকা দীর্ঘায়িত না করেও বলা যায়, বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাঁরা পরিচিত বামপন্থী, বা ঘোষিতভাবে সিপিএম কর্মী অথবা সমর্থক, মূলত তাঁরাই সামিল হয়েছিলেন শুক্রবার কলকাতায় কামদুনির ধর্ষণবিরোধী মিছিলে৷ সঙ্গে অবশ্যই ছিলেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে কলেজ, বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা৷ কলেজ স্কোয়্যার থেকে মিছিল হাঁটল ধর্মতলা পর্যন্ত৷
আগের দিন, বৃহস্পতিবার, আরও একটি প্রতিবাদ সভা হয় এই কলেজ স্কোয়্যারেই৷ সেই সভায় হাজির ছিলেন অভিনেত্রী-চিত্র পরিচালিকা অপর্ণা সেন, শিক্ষাবিদ সুনন্দ সান্যাল, অভিনেতা কৌশিক সেন, নাট্য ব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী, অধ্যাপক তরুণ সান্যাল, শিল্পী সমীর আইচ, ঘটনাচক্রে যাঁরা প্রত্যেকেই পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট শাসনের অবসান ঘটিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নয়া সরকার গঠনের দাবি তোলা তথাকথিত পরিবর্তনপন্থী বুদ্ধিজীবী৷ বাম সরকারের আমলে নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনার পর এই কলেজ স্কোয়্যার থেকেই ওঁরা মিছিল করে গিয়েছিলেন৷ এত তাড়াতাড়ি, মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে, সেটা বোধহয় ওঁরা কেউই ভাবেননি৷ তবে পুনরাবৃত্তি শুধু প্রতিবাদেরই না, নিরাপদ সৃজনশীলতার খোলসের আশ্রয়ে থাকা বুদ্ধিজীবী সমাজের বিলম্বিত, সাবধানী প্রতিক্রিয়ারও পুনরাবৃত্তি হল৷
কামদুনির কলেজ ছাত্রীর নৃশংস ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা ঘটেছিল চলতি জুন মাসের ৭ তারিখ৷ তার আগে এবং পরেও একাধিক ধর্ষণ ও নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটে গিয়েছে এই রাজ্যে৷ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখন পশ্চিমবঙ্গই নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধের তালিকার শীর্ষে রয়েছে৷ কামদুনি যে অঞ্চলে, সেই বারাসতেই ঘটে গিয়েছে দিদির শ্লীলতাহানি রুখতে গিয়ে কিশোর বাইয়ের প্রাণহানির ঘটনা৷ গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে খাস কলকাতা শহরে, পার্ক স্ট্রিটের মতো অভিজাত রাস্তায়৷ কিন্তু ঘটনা কখনই এমন নয় যে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ধর্ষণ ঘটত না৷ কাজেই কামদুনির ধর্ষণের ঘটনা হঠাৎ বুদ্ধিজীবীদের বিবেক জাগ্রত করে থাকলে, সেটা বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে৷ যেহেতু ধর্ষণের থেকেও এখন বড় সমস্যা হচ্ছে সেই ধর্ষণের ঘটনায় শাসকগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া৷
অনেক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে সাড়া জাগানো বানতলা গণধর্ষণের ঘটনায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু একটি নির্মম মন্তব্য করেছিলেন, ওরকম তো হয়েই থাকে৷ একজন প্রশাসকের বিবেকহীন অমানবিকতার দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রবাদ হয়ে আছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্য৷ সেই নিরিখে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিককালের প্রত্যেকটি ধর্ষণের ঘটনার পর রাজ্যের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিটি মন্তব্য একই সহানুভূতিহীনতার নজির রাখছে৷ কোনও ধর্ষণকে তিনি বলছেন সাজানো ঘটনা, ধর্ষিতার চরিত্র খারাপ বলছেন তাঁর দলের নেতা-নেত্রীরা, আবার কোনও ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে সমবেদনা জানাতে মুখ্যমন্ত্রীর ১০ দিন লেগে যাচ্ছে৷
সেখানে বুদ্ধিজীবীরা সময় নিলেন ১৪ দিন৷ সেটাও গণ মানসিকতা কোন দিকে গড়াচ্ছে, তার আন্দাজ পাওয়ার পর৷ যারা এর আগে সরাসরি রাস্তায় নেমে পরিবর্তন চেয়েছিলেন, তাঁরা সম্ভবত কিছুটা চক্ষুলজ্জাতেই আগের দিন একটা সমাবেশ করে দায় সারলেন, কিন্তু মিছিলে হাঁটলেন না৷ এবং সবথেকে বড় কথা, কেউ বললেন না যে ধর্ষণ নয়, আরও বড় সঙ্কট হল সেই ধর্ষণ নিয়ে প্রসাসনের নিস্পৃহতা৷ আসল বিপদ হল ধর্ষণ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে অসহিষ্ণু মুখ্যমন্ত্রীর তাকে সিপিএম বা মাওবাদী বলে দেগে দেওয়ার সংকীর্ণ রাজনীতি৷ এদিনের মিছিল কলেজ স্কোয়্যার থেকে শুরু হয়ে শেষ হল ধর্মতলায়, পুলিশ ব্যারিকেডের বাধার মুখে পড়ে৷ যদিও এই মিছিল হয়ত যাওয়ার দরকার ছিল প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্র যেটা, সেই মহাকরণের সামনে৷ কিন্তু মিছিলের ওজন বাড়াতে শঙ্খ ঘোষের মতো মানুষকে যেখানে সামিল করাতে হয়েছিল, সেখানে মহাকরণের সামনে বিক্ষোভ হয়ত একটু বেশিই ঝুঁকি হয়ে যেত৷
ঘটনাচক্রে একই দিনে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল তৃণমূলপন্থী কর্মীরা৷ আর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসানসোলের এক জনসভায় অবজ্ঞায় মুখ বেঁকিয়ে বললেন, ওই যারা আগেরবার শেষের দিকে মিছিলে এসে হাত নাড়িয়েছিল, তারাই আবার রাস্তা-ঘাট আটকে কী সব করেছে৷
তাহলে কী লাভ হলো মিছিল করে?