অবহেলা, অপমান, নির্যাতন
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫সংবাদ এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেকদিন ধরেই চলছে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, সম্পত্তি দখল, দেশত্যাগ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে লেখালেখি৷ তবে সেসব লেখায় আগের মতো এখনো কোনো আশা সঞ্চারের উপকরণ নেই৷
সম্প্রতি অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন পুরোপুরি বাস্তবায়ন করার জন্য সরকারের প্রতি জোরালো দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ৷ বেদখল হয়ে যাওয়া সম্পত্তি প্রকৃত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঘুস, দুর্নীতি ও হয়রানির বিষয়গুলোও তুলে এনেছেন তারা৷
আইনটির যথাযথ বাস্তবায়নের বিষয়টি পর্যবেক্ষণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ মনযোগ এবং উদ্যোগও কামনা করা হয়েছে৷
অর্পিত বা সম্পত্তি আইন চালু হয়েছিল ১৯৬৫ সালে, অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে৷ তখন অবশ্য নাম ছিল, ‘শত্রু সম্পত্তি আইন'৷ একসময় নাম হয়ে যায় ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন'৷ আইনের নাম বদলালেও সংখ্যালঘুদের দুর্দশা কমেনি৷ অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন প্রণয়ন করেও অবস্থার সামান্যতম উন্নতিসাধন এখনো পর্যন্ত সম্ভব হয়নি৷ গত ৯ সেপ্টেম্বর অর্পিত সম্পত্তি আইনের ৫০ বছর পূর্তিতেও তাই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকেই তৎপর হওয়ার অনুরোধও জানানো হলো৷
‘কুখ্যাত শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি আইনের ৫০ বছর: জনগণের দুর্দশা' – শীর্ষক এক আলোচনা সভায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই উঠে এসেছে৷ স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশে ৩১ ভাগ ধর্মীয় সংখ্যালঘু ছিল, এখন আছে মাত্র নয় ভাগ – এই বাস্তবতা মনে করিয়ে দিয়ে সেখানে বক্তারা বলেছেন, সংখ্যালঘু নিঃসরণের এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পরিণতি ভয়াবহ হবে৷ তাই এখনই একটি নতুন অবস্থার সৃষ্টি করা জরুরি৷
সেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞ, বিতর্কিত এবং গুরুত্বপূর্ণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘‘আমি খুব ভয়াবহ অবস্থা দেখছি৷ যে নয় ভাগ সংখ্যালঘু আছে, তাদেরও ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি৷ গণতন্ত্রও এক রকম ব্যর্থ হচ্ছে৷ এটা অব্যাহত থাকলে এ দেশের গণতন্ত্র আফগানিস্তানের মতো হবে৷''
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অবশ্য এমন কথা অনেক আগে থেকেই লিখছেন অনেকে৷ লেখালেখিতে তেমন কাজ হয় না বলে হতাশাও প্রকাশ করেছেন অনেকে৷ টুইটারে মেহেদি হাসান নামের একজন তেমন হতাশা থেকেই সংখ্যালঘু নির্যাতনের একটি খবর শেয়ার করে লিখেছেন, ‘‘সংখ্যালঘু হামলা, হত্যা, ধর্ষণ, ঘর-বাড়ি, জমি দখল, দেশ ছাড়া করা বাংলাদেশের রোজকার ঘটনা৷ ৯০ শতাংশ ঘটনা গণমাধ্যমে আসে না৷''
আরেকজন হতাশ সমাজের তৃণমূল পর্যায়ে হিন্দুদের অধিকার নিশ্চিত করার কোনো কার্যক্রম না দেখে৷
সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তোলায় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতারাই যে উল্টো সংকটে পড়ছেন সে খবরও জানিয়েছেন একজন৷
আওয়ামী লীগের এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এক হিন্দু পরিবারের সম্পত্তি দখলের অভিযোগ ওঠায় ডয়চে ভেলের কয়েকজন পাঠক কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘‘সংখালঘুদের সম্পত্তি দখলের দায়িত্ব পেয়েছে মন্ত্রীরা৷'' টুইটারে তা-ও শেয়ার করেছেন একজন৷
বাংলাদেশে রাজধানী ঢাকা এবং হাতে গোনা অন্য কয়েকটি বড় শহরের বাইরে সংখ্যালঘুদের সম্মান, নিরাপত্তা এবং সম্পত্তি প্রতিনিয়ত নানাভাবে হুমকির মুখে পড়ে৷ সংবাদমাধ্যমে এমন খবর নিয়মিতই আসে৷
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা এবং হামলার মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়িয়ে একসময় কৌশলে সম্পত্তি দখল করে নেয়া নতুন কিছু নয়৷ তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ঘোষণা শুরুর পরপর এমন হামলা অনেক বেড়েছিল৷ স্রেফ মিছিলে যাওয়ার কারণে সাতক্ষীরার কাঁচামাল ব্যবসায়ী অমিয় দাশের পরিবারের ওপর নির্মম হামলার খবর অনেক পাঠক ডয়চে ভেলের খবরেই জেনেছেন৷ অমিয় দাশের পরিবারের ওপর নেমে আসা সেই বিভীষিকার হৃদয়বিদারক বর্ণনা অনেকেরই হয়ত মনে আছে৷ বৃদ্ধা মা-কে পেটানো, কোলের শিশুকে আগুনে ফেলতে যাওয়া, শিশুর মা-কে প্রহার, লূটপাট এবং এসবের পর স্কুল পড়ুয়া আরেক শিশুর কাছে স্কুলের পথই আতঙ্ক হয়ে যাওয়া – অমিয় দাশের বর্ণনার প্রতি পরতে ছিল বর্বরতার বিপরীতে সংখ্যালঘুর অসহায়ত্বের সকরুণ চিত্র৷
আক্রান্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটি যে ছাই হয়ে যাওয়া ঘর-বাড়ির ক্ষতিপূরণ হিসেবে মাত্র আড়াই হাজার টাকা পেয়েছে সে খবরও ডয়চে ভেলে পাঠকদের জানিয়েছে৷
এমন অত্যাচার নির্যাতন এবং বিচারহীনতার ধারাবাহিকতায় অতিষ্ঠ একজনের প্রশ্ন, ‘‘অবহেলা, অপমান, নির্যাতন আর কত? বাংলাদেশের হিন্দুরা কি এই দেশের নাগরিক না?''
সংকলন: আশীষ চক্রবর্ত্তী
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ