অভিজ্ঞতা নয়, সচিবদের জন্য আনুগত্যের পুরস্কার
২৯ জানুয়ারি ২০২০দৈনিক প্রথম আলোর রোজিনা ইসলামের মারফত জানলাম, সাবেক সচিবরা অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে সরকারের থিংক ট্যাংক হিসেবে কাজ করতে চান৷ আর তা করতে আহ্বান জানিয়েছেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ৷ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানো চিঠিতে তিনি বলেছেন, ‘‘ আপনার অর্জিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা দেশের নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও তার ফলাফলকে ত্বরান্বিত করতেও পারে৷ দেশ ও জাতি এগিয়ে যেতে পারে সবার ইতিবাচক সম্মিলিত প্রয়াসের মধ্য দিয়ে ৷''
আসুন বিষয়টির দিকে একটু নজর দেওয়া যাক৷ যদি আমরা একথা মেনে নেই যে, গত চার দশকের বেশি সময় ধরে এদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি হয়েছে৷ তবে একথাও নিশ্চয়ই মানতে হবে যে, এসব দুর্নীতিতে সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজনৈতিক নেতারা আর তা পরিচালনা করেছেন শীর্ষ আমলারা৷ যারা, মানে যে সচিবরা এই দুর্নীতিযজ্ঞে অংশ নেন নাই তারা তা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন৷ আমরা দুর্নীতির দায়ে রাজনীতিবিদদের, এমনকি সাবেক রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীকে জেল খাটতে দেখেছি, কিন্তু শীর্ষ পর্যায়ের আমলারা থেকে যান ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই৷ গণমাধ্যমও মাঝে মাঝে মিটার রিডার, সার্ভেয়ার, থানার ওসি বা কোনো উচ্চ মানের সহকারী নিয়ে হাফ ডজন চার তলা বাড়ি বা দুই হালি গাড়ি জাতীয় গা-ছমছমে রিপোর্ট করে এ পর্যন্তই৷
কারণ কী? একজন সচিবের আয় কি তার ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? দেশের অভিজাত এলাকায় বড়, মাঝারি বা ছোট সচিবদের এত বাড়ি বা এত ফ্ল্যাট কোত্থেকে আসে? কেন সচিবদের স্ত্রী বা পুত্র কন্যারা খুব ব্যবসা সফল হন? কী এমন আলাউদ্দিনের চেরাগ রয়েছে তাদের কাছে? সরকারি চাকরিতে উপরি আয়ের বিষয়টি আমরা এতই স্বাভাবিক করে নিয়েছি যে, তা নিয়ে রসিকতায়ও আমাদের হাসি আসে না৷ আমাদের সবার কাছেই এতদিন ধরে সরকারের আমলা-পুলিশ-কেরানী-ডাক্তার-মোক্তার সবাই খারাপ, শুধু সরকারি চাকরিটা ভালো৷ কী দারুণ, তাই না?
এখন দেখা যাক, সরকারি চাকুরেদের, মানে সচিবদের কথিত অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানের দরকার কেন পড়লো? আর কোন জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার কথা বলা হচ্ছে আসলে৷ আমরা চিরকালই দেখে আসছি রাজনীতিবিদেরা, বিশেষ করে সরকার প্রধানের ইশারা আর বচনেই চলেছে দেশ৷ সেটি বাকশাল, খাল কাটা, পল্লী বন্ধুত্ব, একটি বাড়ি একটি খামার বা ডিজিটাল বাংলাদেশ যা-ই হোক না কেন৷ কী সাজেশন দিয়েছেন আমলারা দেশ পরিচালনায়, কী অবদান রেখেছেন ন্যায় প্রতিষ্ঠায়? খুব সরলিকরণ মনে হলেও আমি সত্যিই এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজি, আপনারাও খুঁজে পেলে জানাবেন নিশ্চয়ই৷
আমলারা সরকারকে খুশি রাখতে চান৷ এই খুশি রাখতে গিয়ে এক সময় তারা আবিস্কার করেন, এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান৷ আর এ ছেড়ে দেওয়া বেশির ভাগ সময়ই স্বর্গ থেকে পতন৷ ততদিনে টাকা হয়েছে বটে, কিন্তু খালি চেয়ারটি নেই বলে কেউ তাদের দেখে আর চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় না৷ এতদিন গুণী, জ্ঞানী, এমনকি কবি বলে সব জায়গায় খাতির পেলেও সাধারণ কবিতা আলোচনাতেও কেউ আর ডাকে না৷ বই মেলার আগে পাণ্ডুলিপি নিয়ে ঘুরতে আর টকশো-র মেহমান হতে প্রযোজকদের নম্বর মুখস্থ করাই তখনকার নিয়তি৷ তাই জীবন বা চাকরি জীবনের শেষে এসে হয়তো মেলাতে বসেন কী পেলেন আর কী পেলেন না৷ দুদক মহাপরিচালক, নির্বাচন কমিশন বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য আর কয়টা পদ? তাই সবাইকে যদি কোনো পদ পদবী দিয়ে রাখা যায়, তবে স্বর্গের সঙ্গে ঠিক বিচ্ছেদটা ঘটে না৷ চেয়ারটা না থাকলেও ছায়াটা থাকে৷ সবাই বলতে গিয়ে অবশ্য ঠিক বলা হলো না, আমলারা জানেন কাকে ডাকতে হবে আর কাকে না ডাকলেও চলবে৷ অভিজ্ঞতা দরকার বলে কী নেগেটিভ অ্যানার্জি (যার অনুবাদ হতে পারে কিছু মৃদু সত্যি কথা) নিতে হবে?
সরকারের জন্যও বিষয়টা উইন উইন৷ কারণ, নিবিড় আনুগত্য নিশ্চিত করতে পুরস্কার একটি আবশ্যকীয় শর্ত৷ নির্বাহী ইচ্ছায় ক্ষণিকের জন্যও যাতে কেউ বাধা না দিতে পারে তার জন্য চোখের সামনে কিছু ঝুলানো তো চাই৷ আর কে না জানে সবাইকে লাইনে রাখতে হলে গাজর আর বেত পদ্ধতিই সর্বোত্তম৷