অভিন্ন নদী ৫৪, চুক্তি শুধু গঙ্গা নিয়ে
১২ জুন ২০১৭সাধারণ হিসেবে ভারত থেকে ৫৩টি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে৷ আর বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করেছে একটি নদী৷ আর সেই নদীটি হলো কুলিক নদী৷ ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গিতে উৎপত্তি হয়ে এটি ভারতে প্রবেশ করেছে৷ এই ৫৪ নদীর মধ্যে মাত্র একটি নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি আছে৷ আর তা হলো গঙ্গা নদী৷ কিন্তু সেই নদীর পানির প্রবাহ হিসাব করা হয় ফারক্কা পয়েন্টে৷ তবে ফারাক্কা পয়েন্টের আগেই অনেক পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশ পায় না বলে অভিযোগ৷
এছাড়া পাঁচ দশক ধরে তিস্তা চুক্তি নিয়ে কথা হলেও কোনো ফল আসছে না৷
নানা সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৭ সালের গঙ্গা চুক্তিতে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশকে কমপক্ষে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল৷ ১৯৮২ সালে তা পরিবর্তন করে শুকনো মৌসুমে নজিরবিহীন কম প্রবাহ হলে তা ভাগাভাগির ফর্মুলা বের করা হয়৷ ১৯৯৬ সালের চুক্তিতেও এমন বিধান রয়েছে৷ ১৯৯৭ সালে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশ গঙ্গা থেকে ১০ হাজার কিউসেক পানি পেতেও ব্যর্থ হয়৷ পরে তা নেমে আসে ৩ হাজার কিউসেকের নীচে৷
নদী রক্ষা বিষয়ক সংগঠন ‘রিভারাইন পিপল'-এর সাধারণ সম্পাদক শেখ রোকন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গঙ্গা চুক্তির ফলে বাংলাদেশের ৪৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা। তবে শুকনো মৌসুমে পানি তেমন পাওয়া যায় না৷ ফারাক্কা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি পরিমাপ করা হয়, সেখানেই শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না৷ গঙ্গার উৎপত্তি হিমালয় থেকে৷ কিন্তু গঙ্গার উজানে উত্তর প্রদেশ, বিহারসহ আরো অনেক প্রদেশে অনেক বাঁধ ও ড্যাম আছে৷ সেখান থেকে পানি প্রত্যাহার হয়৷ ফলে ফরাক্কা পয়েন্টে পানি মাপার আগেই অনেক পানি প্রত্যাহার হয়৷ ওই পয়েন্ট অনেক কম পানি থাকে৷ ফলে মোট পানি প্রবাহের হিস্যা বাংলাদেশ পায় না৷''
উত্তর প্রদেশ বা বিহারে অবাধে পানি প্রত্যাহার করে ভারত৷ এর হিসেবও দিতে চায় না৷ ভারত উজানের দেশ হিসেবে নদীর পানি প্রত্যাহার করে যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, তাতে প্রলুব্ধ হচ্ছে চীন৷ চীনও ব্রহ্মপুত্রের পানি একতরফা সরিয়ে নিতে চায়৷ সেখানে অবশ্য ভারতের উদ্বেগ আছে৷
বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন তিস্তার পানি৷ বাংলাদেশ পাঁচ দশক ধরে তিস্তা পানি চুক্তির চেষ্টা করছে৷ সর্বশেষ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চুক্তিতে রাজি হলেও তিস্তার পথে এখন বাধা পশ্চিম বঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায়৷ আর তিস্তা চুক্তি হলেও তা হবে সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গের উজান থেকে পানি প্রত্যাহারের পর গজলডোবায়৷ ভাগের আগেই ভারত অনেক পানি প্রত্যাহার করে নেবে৷
সংবাদ মাধ্যম এবং নানা গবেষণা থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৮৩ সালে তিস্তা নিয়ে প্রথম একটি সমঝোতা হয়৷ সমঝোতা অনুসারে তিস্তার ৩৯ শতাংশ ভারত ও ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশের পাওয়ার কথা৷ বাকি ২৫ শতাংশের বড় অংশ বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত তিস্তার গতিপথকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন৷ কিন্তু ভারত তা কখনোই মানেনি৷
১৯৮৬ সালে দুই দেশের জয়েন্ট কমিটি অব এক্সপার্টের সভায় বাংলাদেশ নদীর পানি ভাগাভাগির রূপরেখায় ব্রহ্মপুত্র নদের ৭৫ শতাংশ, তিস্তাসহ আটটি বড় নদীর (পদ্মা ও মেঘনা ছাড়া) পানির ৫০ শতাংশ দাবি করে৷ পরে বাংলাদেশ নির্দিষ্টভাবে ২০ শতাংশ পানি তিস্তার নাব্যতার জন্য রেখে দিয়ে বাকি ৮০ শতাংশ সমান ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়৷
তবে শেখ রোকন বলেন, ‘‘তিস্তা এবং মনু এই দু'টি নদী ভারত বাংলাদেশের বিশেষ নদী৷ এই দু'টি নদীতে বাংলাদেশ ব্যারাজ দিয়েছে, ভারতও ব্যারাজ দিয়েছে৷ তিস্তায় শুকনো মৌসুমে পানি থাকে মাত্র পাঁচ হাজার কিউসেক৷ আর তিস্তায় বাংলাদেশ ও ভারতের যে দুটো ব্যারাজ আছে, তার পানি প্রত্যাহার ক্ষমতা ২৫ হাজার কিউসেক৷ শুষ্ক মৌসুমে ভারতের প্রত্যাহার করার ক্ষমতা ১৫ হাজার কিউসেক এবং বাংলাদেশের ১০ হাজার কিউসেক৷ তাই পানি বণ্টন চুক্তি করে দু'টি ব্যারাজ চালনো যাবে না৷ তাই প্রয়োজন অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা বা বেসিন ওয়াইজ ম্যনেজমেন্ট৷ তবে চুক্তি হওয়া প্রয়োজন৷ পানি থাক বা না থাক যতদিন পর্যন্ত না চুক্তি হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত ভাটির দেশ হিসেবে তিস্তার ওপর বাংলাদেশের অধিকার স্বীকৃত হচ্ছে না৷ পানি না থাকলে কোনো দেশই পাবে না৷ পানি থাকলে পাবে৷''
‘রিভারাইন পিপল'-এর সাধারণ সম্পাদক আরো বলেন, ‘‘তিস্তায় পানি নেই এটা একটা প্রচারণা৷ স্যাটেলাইট ইমেজ বা গুগল ইমেজ থেকে তিস্তার পানি স্পষ্ট৷ গজলডোবা থেকে তিস্তার পানি মহানন্দায় নেয়া হচ্ছে৷ মহানন্দা একটা অভিন্ন নদী৷ সেখানেও ব্যারাজ আছে৷ সেখান থেকে পানি নেয়া হয় ডাহুকে৷ সেখানে একটি ব্যারাজ আছে৷ এই তিনটি নদীই বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন নদী৷ এই তিন নদীতে বাংলাদেশেরও অধিকার আছে৷ এই তিনটি নদীই তারা বন্ধ করে পশ্চিমবঙ্গে সেচ এবং ডাহুকে বিদ্যুৎ প্রকল্প করেছে৷''
ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে৷ আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প কংগ্রেস সরকার বাস্তবায়নে অনীহা দেখালেও মোদী সরকার এটা নিয়ে কাজ করছে৷ আর ভারতের আদালতের একটা রায়ও আছে এটা বাস্তবায়ন করতে৷ আন্তঃনদী সংযোগের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র থেকে পানি ভারতের মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণাত্বে নিয়ে যাওয়া হবে৷ ভারত ব্রহ্মপুত্র থেকে পানি মানস, সন্তোষ, ধরলা, তিস্তায় ক্যানাল করে নিয়ে যাবে৷ তারপর পাঞ্জাব, মহানন্দা, বিহার হয়ে পানি নিয়ে যাবে৷ তিস্তা থেকে মেচি, ডাহুক এবং মহানন্দায় পানি নিচ্ছে ভারত৷
শেখ রোকন বলেন, ‘‘মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায় তোরসা এবং জলঢাকার পানি তিস্তায় নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন৷ সহযোগিতার নামে এখন তারা আন্তঃনদী সংযোগ বাস্তবায়ন করতে চাইছে৷ ছোট ছোট প্রকল্প আকারে বাস্তবায়ন করছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমরা ( বাংলাদেশ) ৫৩টি নদী থেকে যে পানি পাই তার ৫০ ভাগ আসে ব্রহ্মপুত্র থেকে৷ একদিকে ব্রহ্মপুত্র, অন্যদিকে বাকি নদীগুলো৷ আসাম অঞ্চলের ৪২টি নদীর পানি আসে ব্রহ্মপুত্রে৷ সেই পানি বাংলাদেশ পায়৷ তাই ব্রহ্মপুত্রের পানি যদি প্রত্যাহার হয় আন্তঃনদী সংযোগের মাধ্যমে, তাহলে তা হবে আমাদের প্রতিববেশ, পরিবেশ, পানির জন্য বিপর্যয়কর৷''
পানি এবং আন্তর্জাতিক নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী মো. ইমামুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ন্যায্যতার জন্য চুক্তি থাকতে হবে৷১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক নদী ব্যবহারের যে কনভেনশন, তা গঙ্গা চুক্তিতে অনেকটাই মানা হচ্ছে না৷ তবুও চুক্তি না থাকার চেয়ে চুক্তি থাকা ভালো৷ এর মূল্য আছে৷ জাতিসংঘের কনভেনশনে বলা আছে, উজানের দেশ নদীকে এমনভাবে ব্যবহার করবে না, যাতে ভাটির দেশের ক্ষতি হয়৷ আমাদের সব নদী নিয়েই ভারতের সঙ্গে চুক্তি হওয়া প্রয়োজন৷ তিস্তার জন্য চেষ্টা চলছে৷ ফেনী নদী আলোচনায় আসছে৷''
নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী মো. ইমামুল হক জানান, ‘‘দানিউব, মিশরের নীল নদ, মেকং একাধিক দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত৷ ১০-১২টি দেশ মিলে যৌথ ব্যবস্থাপনা করছে৷ আমরা তা এখনো করতে পারিনি৷ ভারতের ভিতরেও তামিনাড় সীমান্তে যে কাবেরি নদী আছে তা নিয়ে বিরোধ আছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘ভারতের মেঘালয় থেকে দুষণ আসছে৷ হাওর দূষিত হচ্ছে৷ মাছ মারা যাচ্ছে৷ এটা নিয়েও ভারতের সঙ্গে আমাদের কথা বলা প্রয়োজন৷''
একই কথা বলেন নদী গবেষক আলতাফ পারভেজ৷ তিনি বলেন, ‘‘যৌথ নদী ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন৷ তা থাকলে আমরা অন্তত একদিন আগে জানতে পারতাম মেঘালয়ের পাহাড় থেকে পানির ঢল নামবে৷ আমরা হাওড়ে সতর্ক হতে পারতাম৷''
আলতাফ পারভেজ বলেন, ‘‘অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা হচ্ছে৷ এটা হলে অববাহিকার লোকজন নদীর সব সুফল পাবেন৷''
তবে ইমামুল হক মনে করেন, ‘‘এরমধ্যে একটা করপোরেট চিন্তায় আছে৷ আগে প্রতিটি নদী নিয়ে চুক্তির মাধ্যমে ভাটি অঞ্চলে নদীর অধিকারে স্বীকৃতি আদায় করতে হবে৷
আর এটা আদায় করতে হলে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনকে সক্রিয় করতে হবে৷ অনেক দিন ধরে এই কমিশনের কোনো খবর নাই৷ এই কমিশনের মাধ্যমে নিয়মিত অভিন্ন নদী নিয়ে কাজ করতে হবে৷ বাংলাদেশকে তাদের দাবি তুলতে হবে শক্তভাবে, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে৷ আবেগ দিয়ে নয়৷''
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷