জার্মানিতে অভিবাসন বিতর্ক
২১ জুলাই ২০১৫এক কিশোরী বিতর্কটি উসকে দিলো৷ ১৪ বছরের রিম জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সামনে শরণার্থী হিসেবে নিজের দুর্দশা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কাহিনি তুলে ধরে তাঁকে লজ্জায় ফেলে দেয়৷ এই ঘটনার জের ধরে জার্মানিতে আবার রাজনৈতিক আশ্রয় ও অভিবাসন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
দুই শিবির তাদের যুক্তি-তর্কের বাণ নিয়ে সমরে নেমে পড়েছে৷ কখনো শরণার্থী, কখনো অভিবাসীদের নিয়ে কথা হচ্ছে৷ কেউ ইউরোপীয় নীতিমালা তুলে ধরছে, কেউ অসহায় মানুষের সাহায্যকে মৌলিক মানবিক দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করছে৷ প্রায়ই আর্থিক সংকটের বিতর্ক বাকি সব বিষয়কে ঢেকে দেয়৷ অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ফুলে-ফেঁপে ওঠা সত্ত্বেও জার্মানির জনসংখ্যা কমে চলেছে এবং অভিবাসী বা শরণার্থীদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে৷ অথচ এই সমস্যা মোকাবিলার কোনো টেকসই নীতি এখনো দেখা যাচ্ছে না৷
২০০৪ সাল থেকে জার্মানিতে একে একে ‘গ্রিন কার্ড', অভিবাসন সংক্রান্ত আইন ইত্যাদি নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে৷ অতি সম্প্রতি নতুন এক আইনের আওতায় যে সব বিদেশিকে কোনো বৈধ কারণ ছাড়াই জার্মানিতে থাকতে দেওয়া হয়েছিল, তাদের পাকাপাকিভাবে এ দেশে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছে৷ তবে এর পূর্বশর্ত হিসেবে জার্মান ভাষা জ্ঞান এবং নিজস্ব আয় থাকা চাই৷ রিম ও তাঁর বাবা-মাও হয়তো এই আইনের সুযোগ নিতে পারবে৷ কিন্তু বিদেশি হিসেবে সেই স্ট্যাটাসের স্বীকৃতি পেতে সময় লাগে৷
ইউরোপীয় ইউনিয়ন জুড়ে এক ‘ব্লু-কার্ড'-ও চালু আছে, যার সাহায্যে বাইরে থেকে দক্ষ কর্মীদের আনা যায়৷ জার্মানি এর পূর্বশর্ত হিসেবে এমন এক বাৎসরিক আয়ের অঙ্ক জুড়ে দিয়েছে, যা তরুণ পেশাজীবীদের আওতার মধ্যে সহজে থাকার কথা নয়৷ মোটকথা, অর্থনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখতে জার্মানির অভিবাসনের যে প্রয়োজন রয়েছে, এ নিয়ে আর তেমন সংশয় নেই৷ কিন্তু রাজনীতি জগতের কেউ চট করে ‘অভিবাসন' শব্দটি মুখে আনতে নারাজ৷ কিছু কিছু মহল থেকে অবশ্য অভিবাসন আইনের দাবি শোনা যাচ্ছে৷
বর্তমানে সবাই একই কথা বলতে শুরু করেছে বটে, কিন্তু তাদের সবার উদ্দেশ্য সম্ভবত এক নয়৷ কিন্তু অভিবাসী এবং আশ্রয়প্রার্থীদের বিষয়ে জার্মানিকে আরও সততার পরিচয় দিতে হবে৷ কারণ সিরিয়া, ইরাক ও লিবিয়ার মতো দেশে সংঘর্ষের ফলে আরও বেশি মানুষ ইউরোপের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেবে৷ আফ্রিকার অনেক মানুষ রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এড়াতে ও আরও ভালো জীবনযাত্রার আশায় ইউরোপের দরজায় কড়া নাড়বে৷ নিজেদের দেশে গৃহযুদ্ধের কারণে আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলি কতকাল জার্মানিতে থাকবে এবং আদৌ কোনোদিন ফিরে যাবে কিনা, তাও কেউ জানে না৷ অন্যদিকে আবার সাবেক ইয়ুগোস্লাভিয়ার সেই সব দেশের মানুষ জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে, যে সব দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ এটা সত্যি মেনে নেওয়া কঠিন৷
জার্মানিতে একদিকে শরণার্থীদের বাসস্থানের উপর হামলার ঘটনা ঘটছে, বিদেশি-বিদ্বেষী প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলছে, গরম গরম রাজনৈতিক বুলিও শোনা যাচ্ছে৷ অন্যদিকে এই দেশেই ছোট-বড় অনেক শহরে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী আশ্রয়প্রার্থীদের সহায়তায় এগিয়ে আসছেন৷ এ নিয়ে তেমন চর্চা হয় না, অথচ এই প্রবণতাই জার্মানিকে সমৃদ্ধ করে তুলছে৷
জার্মানির স্যাক্সনি রাজ্যে বিদেশি-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রাখতে রাজনৈতিক নেতারা বেশ কয়েক সপ্তাহ সময় নিয়েছেন৷ বাভেরিয়া রাজ্যেও এমন অপ্রীতিকর সুর শোনা গেছে৷ কিন্তু রাজনীতি জগতের এমনভাবে কাউকে বিচ্ছিন্ন করার অধিকার নেই৷ তার কাজ হলো মানুষকে বোঝানো যে, শরণার্থীদের গ্রহণ করা, সমাজের মূল স্রোতে বিদেশিদের সমন্বয়, পারস্পরিক মেলবন্ধন – এ সব সমাজকে সমৃদ্ধ করে৷ কিন্তু তার জন্য অনেক পরিশ্রম, অনেক উদ্যোগেরও প্রয়োজন হয়৷ শরণার্থী, সমাজ, রাজনীতি জগত – সবাইকে সেই কাজ করতে হয়৷ জার্মানি তথা ইউরোপের রাজনীতি জগতের সামনে বিশাল দায়িত্ব অপেক্ষা করে রয়েছে৷ বিষয়টি সম্পর্কে গঠনমূলক অবস্থান নিতে আর বিলম্ব করলে এবং বিদেশিদের ‘ইন্টিগ্রেশন'-কে আর অপ্রিয় দায়িত্ব হিসেবে দেখলে চলবে না৷