মৃত্যুর অপেক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী?
২৭ জুলাই ২০১৮অসুস্থতার কারণে জ্যোতি বসু অবসর নেওয়ার পর, দলের নির্দেশে, কিছুটা নিমরাজি হয়েই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদে বসেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য৷ তার আগে তিনি ছিলেন রাজ্যের তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রী, ব্যক্তিগত জীবনেও মগ্ন থাকতেন নিজের পছন্দের দুই বিষয়, সাহিত্য এবং সিনেমায়৷ পড়াশোনা করতে, সিনেমা দেখতে ভালোবাসতেন, প্রবল উৎসাহ ছিল সেই নিয়ে আলোচনা করতে৷ সেই দু'টি কাজই একেবারে বন্ধ করে দিতে হয়েছে বুদ্ধবাবুকে৷ দৃষ্টিশক্তির সমস্যা তাঁর আগে থেকেই ছিল৷ মাঝে কিউবা গিয়ে চিকিৎসা করিয়েও এসেছিলেন এবং তার পর দীর্ঘ সময় ভালোই থেকেছেন৷ কিন্তু এখন তাঁর একটি চোখের দৃষ্টি একেবারেই নেই, অন্যটিতেও ক্ষীণ, প্রায় না থাকার মতো৷ ফলে পড়াশোনার কাজ থেকে পুরোপুরি সরে আসতে হয়েছে৷ বুদ্ধদেবের চোখের অবস্থা এখন এতটাই সঙ্গিন, যে বৈদ্যুতিক আলোর তীব্রতা সহ্য করতে পারছেন না তিনি৷ ফলে ঘরের মধ্যেও আলো নিভিয়ে থাকতে হচ্ছে তাঁকে৷ এর সঙ্গে বাড়তি হিসেবে যোগ হয়েছে পুরনো শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা৷ ডাক্তারির পরিভাষায় ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজঅর্ডার, সংক্ষেপে সিওপিডি৷ অনেক বছর ধরেই এই রোগ বুদ্ধদেবের সঙ্গী৷ নিয়মিত এবং লাগাতার ধূমপান করে এই রোগ তিনি আরও জটিল করে তুলেছেন, তাই এখন সেটি নিরাময়ের অযোগ্য হয়ে উঠেছে৷
এর পরেও চিকিৎসার সাহায্যে রোগযন্ত্রণা কিছুটা কম করা যেত, কিন্তু বুদ্ধদেব সে সুযোগও নাকি দেবেন না নিজের পরিবার এবং পার্টিকে৷ চিরকালই জেদি বলে পরিচিত বুদ্ধদেব নাকি এখন একদম বেঁকে বসেছেন৷ তাঁর অসুস্থতার খবর পেয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কয়েক মাস আগে একদিন হঠাৎই চলে গিয়েছিলেন দক্ষিণ কলকাতার পাম অ্যাভিনিউর যে সরকারি আবাসনে বুদ্ধদেব এখন থাকেন, সেখানে৷ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর ফ্ল্যাটের জীর্ণ দশা দেখে মুখ্যমন্ত্রী অবিলম্বে সেটি মেরামতির নির্দেশ দেন রাজ্য পূর্ত দপ্তরকে৷ একই সঙ্গে মমতা প্রস্তাব দেন, বুদ্ধবাবুর চিকিৎসার সব খরচ বহন করবে সরকার৷ নিজের পছন্দের যে কোনো জায়গায় নিজের চিকিৎসা করতে পারেন তিনি৷ কিন্তু বুদ্ধদেব তখন সৌজন্যের খাতিরে সায় দিলেও শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা করাতে রাজি হননি৷ রাজনৈতিক মহলের জল্পনা, তীব্র অভিমান থেকেই বুদ্ধবাবু বিনা চিকিৎসায়, একান্তে মৃত্যুর অপেক্ষা করছেন এখন৷
প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন এই অভিমান? সহজবোধ্য, সম্ভাব্য কারণ দুটি৷ পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বাম শাসনের পতনের জন্য এখনও রাজ্যের বাম সমর্থকদের একাংশ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য়ের অনমনীয় মনোভাব এবং হঠকারিতাকেই দায়ী করেন৷ বার বার এই প্রসঙ্গ উঠলে তুলনা হয় পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অহংসর্বস্ব মনোভাবের৷ ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে বিপুল, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, জনসমর্থন পেয়েও তিনি যে সেটা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেকথা আজও বাম ভোটাররা বলেন৷ আর দ্বিতীয় কারণটি পুরোদস্তুর সাংগঠনিক৷ পশ্চিমবঙ্গে বামেদের মহাপতনের জন্য দলের ভেতরেও সম্ভবত বুদ্ধদেবকেই দোষের ভাগ নিতে হয়েছিল৷ বাম দলগুলি সবসময় সাংগঠনিক স্তরে সমবেত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কাজ করে, ব্যক্তিমানুষের ইচ্ছে বা অনিচ্ছেকে দূরে সরিয়ে রেখে সেই যৌথ সিদ্ধান্তকেই মেনে নিতে হয়৷ যেভাবে জ্যোতি বসু দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, স্রেফ দল চায়নি বলে৷ কিন্তু ব্যর্থতার ক্ষেত্রে সম্ভবত যৌথভাবে তার দায়ভার নেওয়া হয়নি৷ সবার আঙুল উঠেছিল মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দিকে৷ অভিমান হয়ত সেই কারণেও৷