অসমে নাগরিকপঞ্জি, চূড়ান্ত বিভ্রান্তি
২ আগস্ট ২০১৮ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের ভাইপো ভারতীয় নাগরিক নন! প্রশ্নটা উঠছে কারণ, প্রকাশিত নাগরিকপঞ্জিতে তাঁর নাম নেই৷ বাদ পড়েছেন ‘অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট'-এর বিধায়ক অনন্ত মালো৷ সরকারি তালিকার অসঙ্গতি কতটা ভুলে ভরা তা পরিস্থিতি বোঝাতে নিজের অজান্তেই সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হয়ে উঠেছেন ভারতীয় জনতা পার্টির ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বিধায়ক রামপদ দেউরি৷ ৪০ লক্ষ মানুষের সঙ্গে তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন খোদ জাতীয় নাগরিকপঞ্জির রাজ্যপ্রধান প্রতীক হাজেলাও৷ তবে এতসবের মধ্যেও তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন কট্টর ও চরমপন্থি ভারতীয় জঙ্গি পরেশ বড়ুয়া৷
নাগরিকপঞ্জি নিয়ে শোরগোলের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে এক নেতা বলছেন নাকি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবেন৷ ৮ লক্ষ রোহিঙ্গার পর এবার ৪০ লক্ষ বাঙালিকে (হিন্দু ও মুসলমান) রাষ্টহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হচ্ছে বলে মনে করছেন বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ৷
কথা হচ্ছিল ‘আসাম রাজ্য নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সমন্বয় সমিতি'-র চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্যের সঙ্গে৷ সম্প্রতি একটি বাংলা দৈনিকে অসমবাসীর অধিকার নিয়ে কলম ধরায় জেল খাটতে হয়েছে তাঁকে৷
প্রথম তালিকা থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়েছিল৷ পরে, দ্বিতীয় তালিকায় ঠাঁই পেয়েছেন তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যরা৷ কিন্তু তাঁর আত্মীয়, বন্ধুরা বাদ পড়েছেন৷ এই তালিকা থেকে বাদ পড়ার অর্থ হলো, ‘তুমি ভারতীয় নও'৷ ডয়চে ভেলেকে তপোধীর বললেন, ‘‘বহু ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি যে, পরিবারের একজনের নাম থাকলে বাকিদের নাম নেই৷ ইচ্ছে করে বাঙালিদের ‘টার্গেট' করা হচ্ছে৷ হিন্দু-মুসলিম ছাড়াও অন্যান্য ভাষার মানুষদের প্রতি জাতি বিদ্বেষ ছড়ানোই এর লক্ষ্য৷ বলা হচ্ছে, অসমে থাকতে হলে এসমিয়াদের প্রভুত্ব মেনে চলতে হবে৷ ১৯৪৭ সালে এর সূত্রপাত হয়েছিল৷ সেই বিষবৃক্ষ মহীরুহে পরিণত হয়েছে৷ ঝাড়খন্ড ও মধ্যপ্রদেশ সরকার অসম সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে৷ তারাও নাগরিকপঞ্জি করে বাঙালিদের তাড়াতে চায়৷''
এদিকে, সোমবার সকাল থেকে সমস্যায় পড়েছিলেন ‘দ্য অসম ট্রিবিউন'-এর দিল্লির ‘চিফ অফ ব্যুরো' কল্যাণ বড়ুয়া৷ সদ্য প্রকাশিত এনআরসি-তে তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর নাম নেই৷ তবে স্বান্তনা পুরস্কারের মতো তাঁর মেয়ের নামটি রয়েছে তালিকায়৷ দিনভর টানাপোড়েনের পর রাতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন৷ জানালেন, ‘যাক, আমাদের নামগুলো আছে'৷ অন্যদিকে, ভারতীয় সেনার অবসরপ্রাপ্ত কর্মী আজমল হকের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল ‘ফরেন ট্রাইবুনাল'-এর একটি মেসেজ৷ তাঁকে বলা হয়েছিল, সরকারি ভাবে তাঁকে ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ পেশ করতে হবে৷ খুব স্বাভাবিক ভাবেই মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা হয়েছিল আজমল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের৷ একটানা ৩০ বছর ধরে ভারতীয় সেনায় কর্মরত ছিলেন, তা সত্ত্বেও এমন সরকারি নির্দেশ! সেনাকর্মী হিসেবে আজীবন সরকারি নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এসেছেন৷ এবারও তাই করলেন৷ সমস্ত নথি জমা দিলেন৷ কিন্তু গত সোমবার জাতীয় নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত খসড়া তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর বড্ড আশা নিয়ে তা খুলে দেখলেন আজমল৷ দুঃখের বিষয় হলো, মোট ২ কোটি ৮৯ লক্ষ নাগরিকের মধ্যে কোথাও তাঁর নাম নেই! কেন্দ্রীয় সরকার ও অসম সরকারকে দুষছেন দু'বছর আগে অবসর নেওয়া প্রাক্তন সেনাকর্মী৷
একইরকম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরেটের অফিসের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি কর্মচারী অতনু পুরকায়স্থের পরিবার৷ তিনি, তাঁর স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের কারও নাম নেই প্রকাশিত নাগরিকপঞ্জিতে৷ তিনি জানালেন, ‘‘টেলিফোন করে আমাকে নথি নিয়ে এনআরসি দপ্তরে ডাকা হয়েছিল৷ আমি বাইরে থাকায় আমার স্ত্রী ও ছেলেকে পাঠিয়েছিলাম৷ সব নথি জমা দিয়ে আসা হয়েছিল৷ এখন দেখা যাচ্ছে, আমাদের কারও নাম নেই৷'' তাঁর ক্ষোভ, ‘‘নাগরিকপঞ্জির নামে কার্যত হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে৷ যখন তখন টেলিফোন করে ডেকে পাঠাচ্ছে৷ কাগজে-কলমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের কথা বলা হলেও বাস্তবে কেউ বাড়িতে আসেননি৷ পাড়ায় ২৭টি পরিবারের বাস৷ কারও বাড়িতে লোক আসেনি৷ অথচ অসমিয়াদের নাম উঠলেও ৪টি বাঙালি পরিবারের কারও নাম নেই৷ এখন এই পরিস্থিতিতে আগামী ৭ আগস্টের পর দেখা করতে বলা হয়েছে৷ কী করব ভেবে উঠতে পারছি না৷''
ভারতীয় জনতা পার্টির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ অবশ্য বিরোধীদের দিকেই আঙুল তুলছেন৷ তাঁর মতে, বিরোধীরা রাজনৈতিক স্বার্থে মিথ্যা রটাচ্ছে৷ বললেন, ‘‘এটা প্রাথমিক খসড়া৷ তালিকা যাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে, তারা অনুপ্রবেশকারী৷ কোনো ভারতীয় নাগরিকের নাম বাদ দেওয়া হয়নি৷ যারা ভারতীয় হওয়ার পরিচয় দিতে পারেননি, তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে৷ যদি কারও আপত্তি থাকে তাহলে তা নিয়ে শুনানি হবে, যাচাই হবে, তারপর চূড়ান্ত হবে৷ তাছাড়া আরও একটি জানার বিষয় আছে৷ তা হলো, এই এনআরসি এলো কোথা থেকে? দেশবাসীর জেনে রাখা উচিত, দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৮৫ সালের ১৪ আগস্ট রাত ৩টেয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ‘অসম অ্যাকর্ড' স্বাক্ষর করেছিলেন৷ তাতে অসমে ভারতীয় নাগরিকদের তালিকা তৈরির কথা বলা হয়েছিল৷ বর্তমান সরকার তাই করছে৷''
অন্যদিকে, অসম নাগরিক পঞ্জি ইস্যুতে একই সুর পশ্চিমবঙ্গের চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই রাজনৈতিক দল তৃণমূল এবং সিপিএম নেতাদের গলায়৷ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ৪০ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়ার বিরোধিতা করেছেন৷ শুধু তাই নয়, এই বিষয়ে তিনি দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে দেখা করে নালিশ করেছেন৷ অসমে কার্ফু জারির নিন্দা করেছেন৷
রাজ্যের সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘বিজেপির ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়েছে৷ ওরা সৌহার্দ্য-বিরোধী দল৷ বাংলা ও বাঙালি-বিরোধী৷ অতীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে অমর্ত্য সেনকে সম্মান দেয়নি৷ এখন সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে৷''
তবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, ‘‘অসম অথবা কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার আগে থেকেই নাগরিক পঞ্জি তৈরির কাজ চলছে৷ বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে সম্পন্ন হচ্ছে৷ সরকারের কিছুই করার নেই৷ বিরোধীদের অভিযোগ ভিত্তিহীন৷'' রাজনাথ আরও বলেছেন, ‘‘যে তালিকা প্রকাশ পেয়েছে সেটিই চূড়ান্ত নয়৷ ২.৮৯ কোটি নাগরিকের নামের তালিকা প্রকাশ হয়েছে৷ ২৮ আগস্টের পর যে কেউ তাঁর আর্জি জানাতে পারবেন৷ অভিযোগ নথিভুক্ত করতে পারবেন৷ সর্বোচ্চ আদালতের নজরদারিতে নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনেই সেগুলির নিস্পত্তি করা হবে৷ তাতেও কেউ খুশি না হলে তিনি ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হতে পারবেন৷ তাই বিরোধীদের অনুরোধ, অযথা আতঙ্ক ছড়াবেন না৷ যদি সরকারের ভুল ধরেন, তাহলে বলে দিন সরকার কী করণীয় আছে?''
খুব স্বাভাবিক ভাবেই এনআরসি থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষের বাদ পড়ার সমর্থনে সুর চড়িয়েছেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ৷ সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ‘‘শুধু অসমে নয়, বিজেপি যদি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে তাহলে সেখানেও অনুপ্রবেশকারীদের গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হবে৷''