অস্তিত্ব সংকটে আফগান হিন্দু ও শিখরা
১ অক্টোবর ২০২০কয়েক দশক আগেও আফগানিস্তানে শিখ ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি ছিল৷ কিন্তু এখন সে সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে কেবল ৭০০ জনে৷
দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যের শিকার হয়ে এলেও অনেকেই নিজের জন্মভূমি আঁকড়ে ধরেই বাঁচার স্বপ্ন দেখছিলেন৷ কিন্তু ইসলামিক স্টেটের নানা আক্রমণ থেকে সরকারের নিরাপত্তা না পেয়ে অনেকেই আফগানিস্তানে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন৷
হামদর্দ তার পারিবারিক পদবি৷ সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার জন্যও হেনস্থার শিকার হওয়ার ভয়ে পুরো নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনি৷ হামদর্দ জানান, ‘‘আমরা এখন আর এখানে থাকতে পারবো না৷'' তিনি জানান, মার্চ মাসে শিখ মন্দিরে ইসলামিক স্টেটের হামলায় তার বোন, ভাতিজা এবং শ্যালকসহ অন্তত ২৫ জন শিখ ধর্মাবলম্বী মারা গিয়েছেন৷
হামদর্দ মনে করেন, নিজের মাকে ফেলে কোথাও যাওয়ার মতোই নিজের মাতৃভূমি ছাড়াও সমান কষ্টের৷ কিন্তু তারপরও তাকে অন্য শিখ ও হিন্দুদের সঙ্গে আগস্টে আফগানিস্তান ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে৷ পরবর্তীতে ভারত থেকে তৃতীয় কোনো দেশে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের৷
শিখ এবং হিন্দু আলাদা ধর্ম, এমনকি তাদের পবিত্র বই ও মন্দিরও আলাদা৷ কিন্তু ছোট সম্প্রদায় এবং সমানভাবে আক্রমণের শিকার হওয়ার কারণে আফগান শিখ ও হিন্দুরা নিজেদের মধ্যে এক ধরনের ভ্রাতৃত্ব খুঁজে পান৷ ফলে অনেক ক্ষেত্রেই আফগান শিখ ও হিন্দুরা একই মন্দিরে নিজেদের প্রার্থনা করেন৷
বর্তমান অবস্থার জন্য অতীতের সব সরকারকেই দায়ী করেন হামদর্দ৷ ২০০১ সালে মার্কিন আগ্রাসনের পর স্থানীয় যোদ্ধারা তাদের বাড়ি-ঘর দখল করে নেয়৷ এরপর থেকে তাকে কাবুলের একটি শিখ মন্দিরে আশ্রয় নিতে হয়েছে৷
১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে শিখ ও হিন্দুদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্য হাতে হলুদ ফিতা পরার নির্দেশ দেয় তালিবান৷ তবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরবর্তীতে এ নির্দেশ আর কার্যকর করা হয়নি৷ গত কয়েক দশকে নানা সময়ে অবৈধভাবে দখল হওয়া বাড়ি-ঘর, ব্যবসা এবং মন্দির আর ফিরে পাননি শিখরা৷
১৯৯২ থেকে ১৯৯৬-এর মধ্যে বিভিন্ন গোত্রের লড়াইয়ের সময় কাবুলের হিন্দু মন্দিরগুলোও ধ্বংস হয়৷ এই লড়াই থেকে বাঁচতে তখন অনেকেই আফগানিস্তান ছেড়ে পালিয়েছিলেন৷
২০১৮ সালেও জালালাবাদ শহরে আইএসের এক আত্মঘাতী হামলায় ১৯ জন প্রাণ হারান, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন শিখ ধর্মাবলম্বী৷ নিহতদের মধ্যে এক শিখ নেতাও ছিলেন, যিনি আফগান পার্লামেন্টে নির্বাচনেও দাঁড়িয়েছিলেন৷
বিদেশে বসবাসরত আফগান শিখদের নেতা চরণ সিং খালসা বলেন, ‘‘ছোট একটি দেশে এত বড় বড় হামলার ঘটনা মেনে নেয়া যায় না৷'' শিখদের মধ্যে এতটাই ভয় কাজ করছে যে, বিদেশে থেকেও নিরাপত্তাজনিত কারণে নিজের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি চরণ সিং৷ দুই বছর আগে কাবুলে চরণ সিংয়ের ভাইকে অপহরণ করে হত্যা করে বন্দুকধারীরা৷ এরপরই দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি৷ চরণ সিং বলেন, গত তিন বছর ধরে সব আফগানই খুব বাজে সময় কাটাচ্ছেন, তবে শিখ এবং হিন্দুদের জন্য পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
আইএসের হুমকি থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় সম্প্রদায়গুলোর নেতারাও সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন৷ ২০১০ সালে আফগান সরকার সিদ্ধান্ত নেয় ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে আসন সংরক্ষণের৷ তখন থেকে শিখ সম্প্রদায় থেকে দুজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছেন৷
কিন্তু চরণ সিং মনে করেন, এই আসন কেবলই প্রতীকী, বাস্তবে এর কোনো ভূমিকা নেই৷
গত মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির মুখপাত্র সাদিক সিদ্দিক জানান, দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হলেই শিখ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের আফগানরা আবার দেশে ফিরবেন৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তারিক আনান বার্তা সংস্থা এপিকে বলেন, ‘‘আমরা জনগণের নিরাপত্তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থাই নেবো৷ তাদের (শিখ ও হিন্দু) মানসিক ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে আমরা বদ্ধপরিকর৷''
ঠিক কী ধরনের নিরপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়নি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে৷ এই ব্যবস্থা কবে বাস্তবায়ন হবে, সে বিষয়েও জানা যায়নি বিস্তারিত৷
এমন অবস্থায় দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া আফগান সংখ্যালঘুদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে৷ তাদের বেশিরভাগই পার্শ্ববর্তী হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে আশ্রয় নিচ্ছেন৷ ভারতে বিশাল সংখ্যক শিখ জনগোষ্ঠীরও বসবাস৷
কেবল আগস্টেই ১৭৬ জন আফগান শিখ ও হিন্দু বিশেষ ভিসায় ভারতে আসেন৷ চরণ সিং জানান, যাদের কাবুল থেকে আসা ও জীবনযাপনের পর্যাপ্ত অর্থও নেই, তাদের আর্থিক সহায়তাও করছে ক্যানাডা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাস করা শিখ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি গ্রুপ৷
একাধিক ক্যানাডিয়ান আইনপ্রণেতা দেশটির অভিবাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতি আফগান শিখ ও হিন্দুদের ক্যানাডায় অভিবাসন ও পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ প্রকল্প হাতে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷
সব সত্ত্বেও শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার তীব্র কষ্ট ভুলতে পারছেন না তারা৷ হামদর্দ বলছিলেন, ‘‘নিজের জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়া খুব কষ্টের, কিন্তু আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই৷ আফগানিস্তান আমাদের আর চায় না৷''
এডিকে/এসিবি (এপি)