আত্মপরিচয় নির্মাণ, আত্মঅনুসন্ধানের জায়গা বইমেলা
৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না, বছরের পর বছর ধরে, একুশের বইমেলা প্রকাশক তো বটেই, যাঁদের লেখালেখির অভ্যাস আছে, যাঁরা লেখেন এবং যাঁরা বই পড়তে ভালোবাসেন, তাঁদের কাছে রীতিমতো একটা বাৎসরিক উৎসবের মতো৷ যে উৎসব মোটা দাগে লেখক-পাঠক-প্রকাশক এই ত্রিপক্ষীয় উদযাপনের উপলক্ষ৷ সেই আশির দশকের শেষ দিকে, যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন ছাত্রী, তখন থেকেই সহজ কৌতুহলী পদক্ষেপে আমার মেলা প্রাঙ্গণে আনাগোনা শুরু৷ তখন ছিল হাতে গোণা কয়েকটি স্টল, অল্পসংখ্যক মানুষ, পরিচিত-অপরিচিতদের সঙ্গে আড্ডা দেয়ার আন্তরিক পরিবেশ৷ পত্রিকার পাতায় লেখা হতো, আজ কোন কোন কবি লেখক মেলায় এসেছেন, কার নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে, ধূলায় কেমন নাকাল হয়েছে ক্রেতা-দর্শকরা৷
তারপর থেকে তো প্রতিবছরই চোখের সামনে মেলার কত রূপ-রূপান্তর দেখলাম৷ কখনো সাধারণ মানুষের আকর্ষণ বাড়াতে বাহারি পণ্যের পশরায় ভরা মেলা নিলো বারোয়ারি চেহারা, কখনো তার রূপ বদলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চললো শুধুই বিশুদ্ধ বইয়ের মেলায়৷ আগে যে মেলা সীমাবদ্ধ ছিল বাংলা একাডেমীর অপরিসর চত্বরে, গত পাঁচ বছরে সেই মেলা বিস্তৃত হয়েছে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের বিশাল প্রাঙ্গণে৷ মেলা বিকশিত হচ্ছে, সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংখ্যায় বাড়ছে বইয়ের প্রকাশনা, বাড়ছে প্রকাশক, লেখক, ক্রেতা, দর্শক৷ শত শত লোক দল বেঁধে মেলায় আসছে, যাচ্ছে, ঘুরছে, বেড়াচ্ছে, ফুচকা খাচ্ছে, যেন এক ধুন্দুমার উৎসব লেগে গেছে৷
তবে, যে প্রশ্নগুলো বই মেলা ঘিরে গত কয়েক বছর ধরে ঘুরে ফিরে উচ্চারিত হচ্ছে, সেগুলো হলো, মেলার আয়তন বাড়লেও বইয়ের প্রকৃত পাঠকের সংখ্যা কি বেড়েছে? বইয়ের প্রকাশনা বাড়লেও মেলায় কি উন্নত ও মানসম্পন্ন বই প্রকাশিত হচ্ছে? বইয়ের বাজার কি আদৌ বড় হয়েছে? প্রকৃত অর্থে, এই বইমেলায় কি ভাষা-সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতির বিকাশ ঘটছে? বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়ন ও উৎকর্ষতা বাড়াতে এই মেলা কি আসলেই কোনো ভূমিকা রাখছে?
কেউ কেউ বলেন, যাঁরা বই কিনেন বা যাঁরা শুধু কাগজের বই পাঠ করেন, শুধু তাঁরাই যে পাঠক, তা তো নয়৷ তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে মানুষ অনলাইনেও প্রচুর পড়ে (যদিও সাইবার নেশায় নেশাগ্রস্ত ও ইন্টারনেট আসক্ত তরুণ প্রজন্মের রুচি ও পাঠ কনটেন্ট নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন আছে) সেইসব পাঠককে আপনি গোণায় ধরবেন না কেন? আর যদি গোণায় ধরেন, তাহলে তো পাঠক সংখ্যা বেড়েছে বৈ কমেনি৷
আর এটাও বাস্তবতা যে, বাংলাদেশে বইয়ের মান যাচাইয়ের চিন্তা খুব কমসংখ্যক প্রকাশকই করেন৷ অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেরই নেই কোনো সম্পাদনা পরিষদ৷ নেই পান্ডুলিপির গুণগত মান যাচাই-বাছাই ও পরিমার্জনের ন্যূনতম ব্যবস্থা৷ প্রকাশকরা বলেন, সেজন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হয়, সেই পরিমাণ পুঁজি নেই তাঁদের৷ ফলে মান নির্ণয়ের ভার আসলে পাঠকদের বিবেচনার উপরেই ফেলে রাখতে হচ্ছে৷
এখানেও আবার প্রশ্ন, হাজারো বইয়ের ভিড়ে পাঠক তাঁর পছন্দের বইটি খুঁজে পান তো? কিংবা ভালো বইটি হাতে নেন তো? অনেকেরই অভিযোগ, মেলায় আসা গড়পড়তা দর্শকদের ভালো বইয়ে চোখ নেই৷ বরং মুখ চেনা পরিচিত লোকদের বইয়েরই বেচাকেনা চলতে থাকে৷ আর কিছু শৌখিন, খ্যাতি কাঙাল ‘হঠাৎ গজিয়ে ওঠা' লেখককে করুণভাবে ঘুরতে দেখা যায় মিডিয়ার উন্নাসিক ক্যামেরার পিছু পিছু৷
এবার আসি বইয়ের বাজার প্রসঙ্গে৷ এটা এখন সবাই জানেন, একুশের বইমেলাকে কেন্দ্র করে আমাদের প্রকাশনা শিল্প হয়ে গেছে শুধুই ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক৷ শুধু এই একটি মাসেই যেন আমাদের যত বইপ্রেম, যত গ্রন্থ অনুরাগ, যত ভাষাপ্রেম উপচে পড়ে৷ বাকি এগারো মাস আর বইয়ের খবর নেই৷ এমনকি মেলায় প্রকাশিত বইগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সারা বছর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না৷ তাছাড়া প্রকাশকরাও ফেব্রুয়ারি ছাড়া বই প্রকাশের ঝুঁকি নিতে চান না, তাঁদের কথা হলো, বইমেলা উপলক্ষে যেভাবে বইয়ের খানিকটা প্রচার-প্রচারণা হয়, সারা বছর তো সেটা হয় না৷ যদিও অনেকে মনে করেন, বইমেলাকেন্দ্রিক প্রকাশনা ও বিপণনকে সারা বছরের প্রকাশনায় রূপান্তর না করলে বইয়ের বাজার ছোট থেকে আরো ছোট হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক৷
আর ভাষা, সংস্কৃতির বিকাশ? একুশের চেতনায় অন্তর জারিত হওয়া? হায়, মাসব্যাপী যে লাখ লাখ লোক মেলায় আসে, তারা কোন চেতনা নিয়ে আসে, কিংবা কোন চেতনা নিয়ে ফিরে যায়? এখন মেলায় গেলে দেখতে পাই, কিছু মানুষ উদভ্রান্তের মতো হাঁটছে, উদ্দেশ্যহীনভাবে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত৷ তারা এমনকি কোনো স্টলে দাঁড়াচ্ছেও না, একটা বই হাত দিয়ে নেড়ে-চেড়েও দেখছে না৷ আসলে বই দেখা, বই পড়া বা বই কেনা কোনোটাই তাদের লক্ষ্য নয়, কী যে লক্ষ্য তা-ও সম্ভবত তাদের জানা নেই৷ কোনো আলোচিত বইকে কেন্দ্র করে বইমেলা জমে উঠতে দেখি না৷ বরং বইমেলা জমে উঠে পয়লা ফালগুনে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে৷ সুশোভিত সুসজ্জ্বিত লাল হলুদ শাড়ি পরা নারীদের মুখর পদচারণায়৷
তাতে অসুবিধা ছিল না, কিন্তু অমর একুশে বইমেলা যে চেতনার কথা বলে, যে ভাষার মর্যাদার কথা বলে বা ভাষা শহিদদের স্মৃতির কথা বলে, মন ও মননের নান্দনিক বিকাশের কথা বলে, তার কোনো ছাপ আমরা কি দেখি ফেব্রুয়ারির এই বিশাল সমাবেশে?
কথাগুলো হয়তো সিনিক শোনাচ্ছে, কিন্তু আমার মনে হয়, এখন আমাদের একটু ভিন্নভাবে ভেবে দেখার সময় হয়েছে৷ এটা ঠিক, সামগ্রিকভাবে আমাদের জ্ঞানচর্চা আর পাঠাভ্যাসের যে নিম্নগতি, তারই প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রের সবখানেই পড়ছে৷ মুদ্রণ যন্ত্র সহজলভ্য হয়ে ওঠাতে সবাই নিজের লেখা প্রকাশ করছে৷ ইন্টারনেটের সুবিধায় এখন সবাই লেখক, সবাই কথা বলছে, শোনার কেউ নেই, সবাই লিখছে, পড়ার কেউ নেই৷ গভীর বোধ বা ভাবনার চেয়ে হালকা মুচমুচে ওয়ানটাইম জিনিসেরই কদর সবখানে৷ বই-ও এখন যেন তাই, ওয়ান টাইম ব্যাপার৷ এক মেলায় যে বই বের হলো, তা আর পরের মেলায় জায়গা পাচ্ছে না৷ মানুষ নতুন কিছু চাচ্ছে, চাচ্ছে নতুন উত্তেজনা, নতুন আকর্ষণ৷ চাচ্ছে শর্টকাটে সব কিছু পেয়ে যেতে, কেউ অধ্যাবসায় বা অনুশীলনের ধার ধারছে না৷
ফলে সর্বত্রই একটা অস্থিরতা৷ একটা তাড়াহুড়া৷ একটা জোর জবরদস্তি, একটা অশান্ত উৎকট প্রদর্শনবাতিকগ্রস্ততা, এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চারিদিকে৷ যাঁরা মেরে কেটে ছুটে এই প্রতিযোগিতায় জিতে যাচ্ছে, তাঁদেরকেই বাহাবা দিচ্ছে অন্যরা৷
‘‘ওহ বই? সেও তো আমি কয়েকটা লিখে ফেলেছি৷''
এই হচ্ছে চিন্তা-ভাবনার নমুনা৷ পুরো সমাজ যখন এই দিকে ছুটছে তখন বইমেলাই বা তার বাইরে যাবে কিভাবে?
তবু এই ডামাডোলের মধ্যেই চোখ বন্ধ করে বইমেলা নিয়ে আমি একটু ভিন্নভাবে ভাবার চেষ্টা করি৷ হয়তো এটি অলীক ভাবনা, বয়ে চলা স্রোতকে উল্টো দিকে প্রবাহিত করার মতোই৷ তবু এই বইমেলাকে আর দশটি সাধারণ পণ্যের মেলার মতো ভাবতে চাই না আমি৷ স্বপ্ন দেখি এমন একটি বইমেলার, যার মেজাজটাই থাকবে বিশেষ ধরনের– শান্ত, ধীর, সুন্দর আর অবাণিজ্যিক৷ বাণিজ্য হবে নিশ্চয়ই, কিন্তু সেটাই যেন একমাত্র উদ্দেশ্য না হয়ে উঠে৷ মূল উদ্দেশ্য হবে, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ও জ্ঞান চর্চার বিকাশ ঘটানো৷ বাণিজ্য-ভাবনাই সেই বইমেলায় মুখ্য হয়ে উঠবে না, বরং মেলা প্রাঙ্গণে সত্যিকারের ভাবুকরা যাবেন, কবি-লেখক-গবেষকরা যাবেন, উন্নত চিন্তা-চেতনা অনুশীলনে আগ্রহী মানুষেরা যাবেন, প্রাণ স্পন্দনে ভরপুর কৌতুহলী তরুণ-তরুণীরা যাবেন৷ প্রবীণ সাহিত্যিকরা তাঁদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করবেন নবীন সহিত্যিকদের সঙ্গে৷ পাঠকরা বিনা দ্বিধায় লেখকদের জানাবেন তাঁদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা৷ তাঁরা সময় নিয়ে খুঁজে খুঁজে দেখে বের করবেন ভালো বই৷ প্রকাশকরা পরের বছর কী বই প্রকাশ করা যায়, তার খসড়া পরিকল্পনা করবেন৷ পরিমাপ করবেন পাঠকদের রুচি, চাহিদা ও আকাঙ্খা৷ মতামত নেবেন বিজ্ঞজনের৷ পর্যালোচনা করে, যাচাই বাছাই করে পরিমার্জিত সুরুচিপূর্ণ নির্ভূল ছাপার বই প্রকাশ করবেন৷ প্রয়োজনে তাঁরা অনলাইনেও সেসব বই রাখতে পারেন, যা অর্থমূল্যের বিনিময়ে ডাউনলোড করতে পারবে আগ্রহীজন৷ মেলার মঞ্চে তাড়াহুড়ার মোড়ক উন্মোচন নয়, মাসব্যাপী দেয়া হবে নতুন বইয়ের পরিচিতি৷ দেশ-বিদেশের পণ্ডিতরা আসবেন বাঙালির সৃজনশীলতার উৎসব উদযাপন করতে৷ আর তখনই, সত্যিকারের জ্ঞান চর্চার জায়গা, সারা বছরের সাহিত্যচর্চার খোঁজ-খবর পাওয়ার জায়গা, আত্ম পরিচয় নির্মাণ আর আত্মঅনুসন্ধানের জায়গা হবে আমাদের প্রাণের মেলা, অমর একুশে বইমেলা৷
বইমেলা আপনার কাছে কী অর্থ বহন করে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷