আদিবাসীরাই প্রাচীন অরণ্য রক্ষা করলেন বলিভিয়ায়
৪ নভেম্বর ২০১১গ্লোবাল ওয়ার্মিং৷ বিশ্ব উষ্ণায়ন৷ সন্ত্রাসবাদ নয়, গোটা বিশ্বের সামনে এই মুহূর্তে এই সমস্যাটিই নাকি সবচেয়ে বেশিমাত্রায় দেখা দিয়েছে এখন৷ বলছেন বিশেষজ্ঞরা৷ বলা হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে কার্বন দূষণের মাত্রা কমাতে না পারলে পরিবেশ এক ভয়ংকর প্রতিশোধ নেবে অচিরেই৷ গলে যাবে মেরুর বরফ, উঠে আসবে সমুদ্র, সে দখল নেবে জমির৷ এবং সবচেয়ে বড় কথা, বন কেটে, জঙ্গল শেষ করে মানুষ তার সভ্যতাকে আরও আরও এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ব্যর্থতা দেখালে একসময়ে এমন দিন আসবে, যখন আর এই গ্রহ বসবাসের যোগ্য থাকবে না মানুষের জন্য৷
এইসব তথ্য নতুন কিছু নয়৷ সেই কবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর'৷ কিন্তু মানুষের লোভের হাত সেই আপ্তবাক্যকে মনে রাখেনি৷ বন কেটে বসতই শুধু নয়, তৈরি হচ্ছে একের পর এক শিল্প, নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ, ধ্বংস হচ্ছে আগামীর সম্ভাবনা৷ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আধুনিক বিশ্ব ঠিক কী রেখে যাবে, তার কোন ইচিবাচক ইঙ্গিতও কোথাও নেই৷
তেমনই এক অপচেষ্টাকে কিন্তু দারুণ সফলভাবে রুখে দিল ল্যাটিন অ্যামেরিকার বলিভিয়া নামের দেশটির আদিবাসীরা৷ যে আদিবাসীরা বলিভিয়ার মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ এবং শেষবারের সাধারণ নির্বাচনে যারা তাদের সম্প্রদায়ের এক প্রতিনিধি ইভো মোরালেসকে বিপুল ভোটে জিতিয়ে দেশের প্রেসিডেন্ট পদে বসিয়েছিল৷
অথচ সেই ইভো মোরালেসের প্রশাসন এই নির্বাচনে বিজয়ের পরেই বলিভিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন ট্রপিক্যাল অরণ্য ইসিবরো সিকিওর ন্যাশনাল পার্কের একাংশকে ধ্বংস করার এক পুরিকল্পনায় হাত দেয়৷ পরিকল্পনা আর কিছুই নয়, দরিদ্র দেশ বলিভিয়ার প্রতিবেশী ব্রাজিল তাদের পরিবহণ, বিশেষ করে কাঠ ও অন্যান্য পরিবহণের কাজের সুবিধার জন্য প্রস্তাব দেয়, ইসিবরো ন্যাশনাল পার্কের বুক চিরে তারা একটি হাইওয়ে নির্মাণ করার পয়সা দিতে রাজি৷ বলা বাহুল্য, যে হাইওয়ে তৈরি হলে ইসিবরো ন্যাশনাল পার্কের সমূহ ক্ষতি হবে৷ ধ্বংস হবে পরিবেশ, বিপন্ন হবে বন্যপ্রাণী এবং তার চেয়েও বড় কথা, বিপন্নতার শিকার হবে এই জঙ্গলকে কেন্দ্র করে বসবাসকারী আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকা৷ কারণ, পুরুষাণুক্রমে এই আদিবাসী সম্প্রদায় সেই ইসিবরোর ট্রপিক্যাল অরণ্যকে ঘিরেই বসবাস করে আসছে৷ জঙ্গল যেমন তাদের বাসস্থান, তেমনই এই জঙ্গলই তাদের আহার, জীবিকা আর পানীয়ের সন্ধান দেয়৷
আদিবাসীরা তাই এই অন্যায় পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে পড়েন সংঘবদ্ধ হয়ে৷ পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে একসময়ে বলিভিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাচা লোরেন্টি আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ জারি করেন৷ হাইওয়ে নিমর্মাণের কাজে বাধা দেওয়াতেই এই গ্রেপ্তারি পরোয়াণা৷ এরপর দ্রুত আন্দোলন আরও জোরকালো হয়ে ওঠে৷ অবশেষে পরিস্থিতি যথেষ্ট গম্ভীর চেহারা নেওয়ায় বাধ্য হয়ে আন্দোলনের পক্ষে জনসমর্থনের চাপে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লোরেন্টি৷ পরিস্থিতি এমন হয়েছে, যে মন্ত্রীদের একে অপরকে দোষারোপ করতে হচ্ছে এখন দোষ স্খালন করতে৷ কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে একটাই দ্রষ্টব্য, আর তাহল, পরিবেশ বাঁচানোর উদ্যোগে আদিবাসীদের ভূমিকা৷
বলিভিয়ার মত দেশে, যেখানে আদিবাসীরা সংখ্যায় যথেষ্ট এগিয়ে, যেখানে খোদ প্রেসিডেন্ট নিজেই সেই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করছেন, সেখানে না হয় এধরণের পরিবেশ ধ্বংসের একটি অনৈতিক উদ্যোগকে রক্ষা করা গেল! কিন্তু, নীতি আর প্রয়োজনীয়তা যেসব দেশের ক্ষেত্রে এ ধরণের বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেনা, সেসব জায়গায় কিন্তু সামান্য আর্থিক বা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করতে এ ধরণের প্রাকৃতিক ক্ষতি ব্যাপক মাত্রাতেই ঘটে চলেছে৷ যার উদাহরণ ভারত বা বাংলাদেশে অহরহ দেখা যায়৷ সেসব বন্ধের জন্য প্রয়োজন সচেতনতা৷ পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচার তাই আরও প্রয়োজন৷ বলিভিয়ার আদিবাসীরা যদি এভাবে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনকে সাফল্য দিতে পারেন, আমরা পারব না কেন?
প্রতিবেদন: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ