জামায়াতের ভবিষ্যৎ কী হবে?
৩ অক্টোবর ২০১৬সেই আইন পাশে এখনো বাস্তব কোনো পদক্ষেপ স্পষ্ট নয়৷ অবশ্য দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন৷ ফলে দলটি এখন আর দলীয়ভাবে এবং নিজস্ব প্রতীক দাড়িপাল্লা ব্যবহার করে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে না৷ এরপরেও রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী এখনো একটি বৈধ রাজনৈতিক সংগঠন৷ তবে দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে এ মুহূর্তে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে৷ তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে? এই নামে দলটি আদৌ কি টিকে থাকতে পারবে?
কেন ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন
এ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর চারজন শীর্ষ নেতার যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে৷ এরা হলেন দলের সাবেক আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান এবং মীর কাসেম আলী৷ জামায়াতের মূল ‘থিংক ট্যাংক' এবং সাবেক আমির গোলাম আযম যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে এরইমধ্যে কারাগারে মারা গেছেন৷
জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে কারাগারে আছেন৷ আরেক সাবেক জামায়াত নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ফাঁসির দণ্ড নিয়ে পলাতক৷ এছাড়া জামায়াত নেতা মাওলানা এটিএম আজহারুল হককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল৷ মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে মুহাম্মদ আব্দুস সোবহানকেও৷ এখন তাদের আপিল শুনানি হওয়ার কথা৷
কারাগারে মারা গেছেন জামায়াতের সাবেক নায়েবে আমীর মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসূফ৷ বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক৷ অপর এক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার জামিনে মুক্তি পেলেও আত্মগোপনে আছেন৷ ফলে জামায়াত যারা চালাতেন বা দলটির মূল নেতৃত্বে ছিলেন, তাদের তেমন কেউই এখন আর নেই৷ হয় ফাঁসিতে ঝুলেছেন, মারা গেছেন, কারাগারে আছেন, নয়ত পালিয়ে বেড়াচ্ছেন৷
তবে এই পরিস্থিতির মধ্যেও জামায়াত নতুন নেতৃত্বে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷ শোনা যাচ্ছে, সহসাই দলের নতুন আমীরের নাম ঘোষণা করতে পারে জামায়াত৷ এ জন্য তাদের অভ্যন্তরীণ ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে৷ জানা গেছে, জামায়াতের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমেদই হচ্ছেন জামায়াতের নতুন আমীর বা দলীয় প্রধান৷
মীর কাসেমের ফাঁসি দলের জন্য বড় ধাক্কা!
যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালালের জন্য জামায়াত সব সময়ই সক্রিয় ছিল৷ বিশেষ করে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘেষণা করার পর, দেশের অন্তত ৩৪টি জেলায় জামায়াত ব্যাপক নাশকতা চালায়৷ পরে অবশ্য আপিলে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় হয়৷
জামায়াত সাধারণত প্রচুর অর্থ খরচ করে বিচার বন্ধ এবং জামায়াত নেতাদের রক্ষায় আন্তর্জাতিক ‘লবিস্ট' নিয়োগ করে৷ এই কাজের নেতৃত্বে ছিলেন মীর কাসেম আলী৷ তিনি মূলত জামায়াতের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান দেখভাল করতেন৷
২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন হওয়ার পর, ১০ মে যুক্তরাষ্ট্রের লবিস্ট ফার্ম ‘কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট'-এর সঙ্গে চুক্তি করেন মীর কাসেম আলী৷ উদ্দেশ্য ছিল, যুদ্ধাপরাধের বিচার বানাচালে প্রচারণা এবং বাংলাদেশ সরকারের ওপর বিচার বন্ধে চাপ সৃষ্টি করা৷ এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং প্রধান নির্বাহী সাবেক মার্কিন কংগ্রেসম্যান মার্টিন রুশো৷ চুক্তিপত্রে জামায়াতের পক্ষে মীর কাসেম আলী নিজে এবং লবিস্ট ফার্মের পক্ষে জেনারেল কাউন্সেল জে ক্যামেরুজ স্বাক্ষর করেন৷ চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালের ৬ অক্টোবর থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৫ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ৬ মাস প্রচারণা চালায়৷ চুক্তি করার এক মাসের মধ্যেই ২০১০ সালের ১৭ জুন গ্রেপ্তার করা হয় মীর কাসেম আলীকে৷ তবে প্রচারণার কাজ অব্যাহত থাকে৷ পরে এই চুক্তি নবায়নও করা হয়৷ সিটি ব্যাংক এন-এর মাধ্যমে ‘ইলেকট্রোনিক মানি ট্রান্সফার' করে চুক্তির প্রথম ছয় মাসের আড়াই কোটি মার্কিন ডলার ফার্মটিকে পাঠানো হয়৷
ধারণা করা হয়, মীর কাসেম আলীর ১৪ হাজার কোটি টাকার সম্পদ আছে৷ ১৬টি প্রতিষ্ঠানের ৩০ হাজারের বেশি শেয়ার আছে মীর কাসেম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে৷ তার তত্ত্বাবধানে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ২০৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা৷ এ সব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ সম্পদই বিভিন্ন কোম্পানি, ট্রাস্ট ও বেসরকারি সংস্থার নামে রয়েছে৷ বৈধভাবে আয়কর রিটার্নে তার সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা৷
তাই গত ৪ সেপ্টেম্বর মীর কাসেম আলির ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় জামায়াতের অর্থনেতিক ভিতে আঘাত লাগে৷
জামায়াতের ইতিহাস
১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট এই উপ-মহাদেশে জামায়াতে ইসলামীর যাত্রা শুরু, জাময়াতে ইসলামী হিন্দ নামে৷ দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী৷ এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দলটির নাম হয় জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান৷ বাংলাদেশ অংশের নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান জাময়াতে ইসলামী, যার প্রধান ছিলেন গোলাম আযম৷ ১৯৬৪ সালে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়৷ তবে কয়েকমাস পরই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়৷
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে জাময়াতে ইসলামী৷ শুধু বিরোধিতা নয়, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আছে দলটির বিরুদ্ধে৷ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসম্বের বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হয়৷ কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর, জাময়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়৷ ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান সুযোগ করে দিলে ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নামে জামায়াত কাজ শুরু করে৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই পালিয়ে যাওয়া গোলাম আযম ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে ফিরে এলে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নামে কাজ শুরু করে দলটি৷
নির্বাচনের রাজনীতিতে জামায়াত
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে জামায়াত তিনটি আসন পায়৷ ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করে দলটি ৩০০ আসনের মধ্যে ১৭টি আসন লাভ করে৷ বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত চার দলীয় ঐক্যজোটের অন্যতম শরিক হিসেবে সরকার গঠনে ভূমিকা পালন করে৷ তাদের দু'জন নেতা মন্ত্রীও হন৷ এরপর ২০০৮ সালের নবম জাতীয় নির্বাচনে তারা ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র দু'টি আসন লাভ করে৷ ২০১৪ সালে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতও দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে৷
জামায়াত বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচনে অংশ নেয় ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে৷ সেবার তারা ১০টি আসন পেয়েছিল৷
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১০ সালে ২৫ মার্চ যুদ্ধাপরাধের বিচারে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করার পর, বাংলাদেশে আবার চাপের মুখে পড়ে জামায়াতে ইসলামী৷ ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামায়াত নেতাদের দণ্ড ছাড়াও দলটিকেও ‘যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক দল’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়৷ এরপর নির্বাচন কমিশন ২০১৩ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে৷ বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় নিবন্ধন বাতিল করা হয়৷
জামায়াত নিষিদ্ধ, জামায়াতের বিচার
বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একাধিকবার বলেছেন যে, জামায়াত নিষিদ্ধে সংসদে আইন পাশ করা হবে৷ আর সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালের আইনও সংশোধন করা হয়েছে৷ কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধে সংসদে আইন পাশের প্রক্রিয়াটি এখনো স্পষ্ট নয়৷ তাছাড়া সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করার জন্য ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা তদন্ত শুরু করলেও, মামলা কবে হবে তা নিশ্চিত নয়৷
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জামায়াত নিষিদ্ধে আইন প্রণয়ন ছাড়াও সরকার চাইলে নির্বাহী আদেশেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে৷ কারণ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে জামায়াতকে সন্ত্রাসী ও যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিবেবে অভিহিত করা হয়েছে৷ তাই সরকার সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এখন চাইলেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারবে৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারেও কোনো বাধা নেই৷ তবে আইনে সংগঠনের বিচার হলে দলটির শাস্তি কী হবে তার উল্লেখ নাই৷ তাই এখানে কিছুটা অস্বচ্ছতা আছে৷''
তাঁর কথায়, ‘‘সরকার যেদিক থেকেই শুরু করুক না কেন, এখন যা পরিস্থিতি তাতে বাংলাদেশে জামায়াতের ভবিষ্যৎ রাজনীতি অন্ধকারাচ্ছন্নই বলা যায়৷''
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা সত্য যে জামায়াত সাংগঠনিকভাবে দূর্বল হয়ে গেছে৷ তবে জামায়াতকে পুরোপুরি দূর্বল ভাবা ঠিক হবে না৷ তাদের অর্থের উৎস এখানো বন্ধ হয়নি৷ তাই তাড়াহুড়ো না করে জামায়াত নিষিদ্ধ করলে এমনভাবে করতে হবে যাতে তারা যেন আর ঘুরে দাঁড়াতে না পারে৷ এই ক্যানসার যদি আবার ফিরে আসে, তাহলে তা হবে আরো ভয়াবহ৷''
তিনি বলেন, ‘‘তাই কোনো রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশ নয়, সত্যিকার অর্থেই যদি কলঙ্কমোচনের জন্য জাময়াতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়, একমাত্র তবেই তা সম্ভব হবে৷''
জামায়াতের ভাবনা
জামায়াতের বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বাইরে থাকা দলের শীর্ষ নেতারা কেউ কথা বলতে রাজি হননি৷ তবে ডয়চে ভেলে কথা বলেছে জামায়াতের সিলেট জেলার আমীর মাওলানা হাবিবুর রহমানের সঙ্গে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘জামায়াত নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করছে৷ নাম প্রকাশ করা হবে দু-একদিনের মধ্যেই৷ তবে আমরা সাংগঠনিক কাজ করতে পারছি না৷ সরকার আমাদের সেটা করতে দিচ্ছে না৷''
জামায়াত নিষিদ্ধের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘সরকার নিষিদ্ধ করলে তো কিছু করার নেই৷ তবে আমাদের দলের নেতা-কর্মীরাতো আছেন৷ আমরা ইসলামের দাওয়াত দেবো৷ নাম পরিবর্তন করবো কিনা, তা তখন দেখা যাবে৷ দ্বীনের দাওয়াত দেয়া থেকে আমরা বিরত থাকবো না৷ আমার বিশ্বাস পরিস্থিতি যা-ই হোক, কেউ দল ছেড়ে যাবেন না৷''
রাজাকারমুকক্ত জামায়াত প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘জামায়াতে ইসলামীতে এখন আর রাজাকার বা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বলে কিছু নেই৷ যারা ছিলেন তারা এখন আর নেই৷''
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে যাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে, আমরা মনে করি তারা শহিদ৷ তারা আমাদের উৎসাহিত করছেন৷''
আপনার কী মনে হয়? জামায়াতের ভবিষ্যৎ কী?