আন্দোলন ‘গুজব' বা ‘উসকানিমূলক' বক্তব্যনির্ভর ছিল না
৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮সরকারের ভেতরে নানা রকমের পন্থা নিয়ে আলোচনা হয়৷ সেই আলোচনার একটি দিক ছিল, বলপ্রয়োগে ভয় দেখিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া৷ রাস্তা থেকে সরানোর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই সামনে আসে ‘গুজব' এবং ‘উসকানিমূলক বক্তব্য'র প্রসঙ্গ৷
কারা বল প্রয়োগ করল, কারা গুজব ছড়ালো, কারা উসকানিমূলক বক্তব্য দিল? সেদিকে একটু নজর দেওয়া যাক৷
১. শিশু- কিশোররা রাস্তায় নেমে আসার তৃতীয় দিন সকালে পুলিশের বড় কর্তারা একটি মিটিং করেন৷ গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে জানা যায়, পুলিশ রাস্তা থেকে শিশু- কিশোরদের সরানোর জন্য সরকারি ছাত্র সংগঠনের সহায়তা নেওয়ার কথা বলে৷ সেদিন বিকেলে মিরপুরে পুলিশ, লাঠি-রডধারী বাহিনী সম্মিলিতভাবে শিশু- কিশোরদের ওপর আক্রমণ করে৷ রাস্তায় সাদা পোশাকের লাঠিধারীরা শিক্ষার্থীদের পেটায়৷ আক্রান্ত হয়ে শিশু-কিশোরদের একটা অংশ ফুটওভার ব্রিজের ওপর উঠে পড়ে৷ পুলিশ ফুটওভার ব্রিজের দুই পাশ দিয়ে উঠে শিশু-কিশোরদের নির্দয়ভাবে পেটায়৷ সেই ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে৷
২. সরকার মনে করেছিল বল প্রয়োগ করলে শিশু-কিশোররা ভয়ে রাস্তা থেকে চলে যাবে৷ ফলাফল হয় উল্টো৷ পরেরদিন আরও বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে আসে৷ আগের দিন শিশুদের পেটানোর প্রতিবাদে বিক্ষুদ্ধ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যোগ দেয়৷
নির্মোহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রথম ‘উসকানিমূলক' কর্ম পুলিশ করেছে, সঙ্গে লাঠিধারীদের নিয়ে৷ পুলিশ না পেটালে, লাঠি-রডধারীদের সঙ্গে নিয়ে না পেটালে, হয়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেদিন আন্দোলনে যোগ দিত না৷
একদিকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অন্যদিকে পুলিশ-সাদা পোশাকের হেলমেট বাহিনী, যাদের হাতে রড-লাঠি-রামদা৷ ধারণা করা হয়, শিক্ষার্থীদের ভেতরে সেদিন সুযোগ সন্ধানী কিছু যুবক ঢুকেছিল৷ তারাই মূলত ধানমন্ডি আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ইট-পাটকেল ছুঁড়েছিল৷ আওয়ামী লীগ অফিসে অবস্থানরত ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীদের সঙ্গে ইট-পাটকেল ছোঁড়া যুবকদের সংঘর্ষ হয়েছে৷ সেই সংঘর্ষে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও যোগ দিয়েছে৷ ছাত্রলীগ বা যুবলীগের শক্তি-সামর্থ্য সম্পর্কে শিশু-কিশোরদের কোনো ধারণা ছিল না৷ তারা আবেগ- উত্তেজনায় ইট-পাটকেল যা পেয়েছে, তা ছুঁড়ে মেরেছে৷ শিশু-কিশোররা এধরণের সংঘর্ষে দক্ষ না হলেও, তারা সংখ্যায় ছিল অনেক৷ কয়েক হাজার শিশু-কিশোর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইট, পাটকেলের সামনে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা দাঁড়াতে পারছিল না৷ এমন প্রতিরোধ তারা প্রত্যাশা করেনি৷ সেই সময় হেলমেট বাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, যাকে সামনে পায় তাকে পেটাতে থাকে৷ সাংবাদিকরা ছবি তুলতে গেলে তাদেরও পেটাতে শুরু করে, ক্যামেরা কেড়ে নেয়৷ জিগাতলা-ধানমন্ডি এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়৷
৩. ‘গুজব' এবং ‘উসকানিমূলক' বক্তব্যের প্রসঙ্গ এই পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে সামনে আসে, আনা হয়৷ ‘গুজব' ছড়ানো এবং ‘উসকানিমূলক' বক্তব্যের অভিযোগ আনা হয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্র শিল্পী শহীদুল আলমের বিরুদ্ধে৷
তিনি সেদিন রাস্তায় বেরিয়েছেন, ধানমন্ডি-জিগাতলা এলাকায় গেছেন৷ রাস্তায় যা ঘটতে দেখেছেন, তা ফেসবুক লাইভে এসে বলেছেন৷ ছবি তুলেছেন, দু'একটা ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন৷ যা ঘটছে তা দেখে বলা ‘উসকানিমূলক' বক্তব্য কিনা, গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয়৷ কোনো দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকলে, যা ঘটছে তা বলা কেনো বিবেচনাতেই ‘গুজব' ছড়ানো বা ‘উসকানিমূলক' বক্তব্য দেওয়া হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে না৷
যদি প্রমাণ করা যেত বা যায় যে শহীদুল আলম যা বলেছেন, যে ছবি পোস্ট দিয়েছেন তা সত্য নয়, তাহলে গুজব ছড়ানো বা উসকানিমূলক বক্তব্যের অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই আনা যায় বা যেত৷ কিন্তু সেসব অসত্য হিসেবে প্রমাণ করা কী সম্ভব? তাহলে প্রমাণ করতে হবে হেলমেট বাহিনীর ছবি অসত্য৷ তারা শিক্ষার্থীদের পেটাচ্ছে, সেই ছবি অসত্য৷ তারা সাংবাদিকদের পেটাচ্ছে, সেই ছবি অসত্য, হেলমেট বাহিনীর হাতের রামদা অসত্য৷ এসব কী আসলে অসত্য?
আল জাজিরার সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিয়ে শহীদুল আলম সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন৷ বিবেচনায় রাখা দরকার সমালোচনা করেছেন সরকারের, দেশের নয়৷ তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে যে কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারেন৷ অসত্য বলতে পারেন, পাল্টা বক্তব্য দিতে পারেন৷ তা না করে গ্রেপ্তার-নির্যাতন করা কি যায়? তাছাড়া সরকারের সমালোচনা, আর দেশের সমালোচনা মোটেই এক বিষয় নয়৷
৪. একথা সত্যি যে, সেদিন ‘গুজব' ছড়িয়েছিল৷ বেশ কয়েকজনকে দেখা গেছে ফেসবুক লাইভে এসে বলছেন ‘৪ জন ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে, ৪ জন মেয়েকে আওয়ামী লীগ অফিসে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে'৷ এই ‘গুজব' রটনাকারী ও ‘উসকানিমূলক' বক্তব্য প্রদানকারীদের চিহ্নিত করে অবশ্যই শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার ছিল৷ কিন্তু তা না করে, পুরো আন্দোলনটিকে ‘গুজব' আর ‘উসকানিমূলক' বক্তব্য দিয়ে চাপা দিতে চেয়েছিল সরকার৷ সেকারণে রটনাকারীদের চিহ্নিত করার চেয়ে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার, রিমান্ডের দিকে বেশি মনোযোগী ছিল৷ গ্রেফতার করা হয়েছিল ‘গুজব' ও ‘উসকানিমূলক' বক্তব্যে দেওয়ার অভিযোগের কথা বলে৷ কিন্তু অধিকাংশের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছিল ‘ভাঙচুর ও পুলিশের কাজে বাধা' দেওয়ার অভিযোগে৷
সুনির্দিষ্ট করে বললে অভিনেত্রী নওশাবা ফেসবুক লাইভে যা বলেছিলেন, তা ‘গুজব' ছড়ানো বা ‘উসকানিমূলক' বক্তব্যের আওতায় পড়ে৷ নওশাবা আন্দোলনের কেউ নয়, ঘটনাস্থলেও ছিলেন না৷ তাঁর দায় কেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নেবেন?
যারা রাস্তায় শিক্ষার্থীদের পানি বা খাবার দিয়েছে, তেমন অনেক নারীদেরও গ্রেফতার করে ‘গুজব' ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছে৷ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে রাস্তায় নেমেছে, পুলিশ তাদেরও গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে৷ ‘পুলিশের কাজে বাধা' এমন বায়বীয় অভিযোগে মামলা দেওয়া হয়েছে৷ অথচ প্রচারণা চালানো হয়েছে যে, এরা ‘গুজব' ছড়িয়েছে ‘উসকানিমূলক' বক্তব্য দিয়েছে৷
৫. ‘গুজব' বা ‘উসকানিমূলক' বক্তব্য, যে-কোনো আন্দোলনের অন্যতম অনুষঙ্গ৷ এই আন্দোলনেও যা ছিল৷ বিরোধীদল এই আন্দোলন থেকে সুবিধা নিতে চেয়েছিল, তাও অসত্য নয়৷ বাস্তবে পুরো আন্দোলন ‘গুজব' বা ‘উসকানিমূলক' বক্তব্যভিত্তিক ছিল না৷ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বা একজন শহীদুল আলম দেশের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র করেছেন বা দেশের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন, তেমন কিছু দৃশ্যমান হয়নি৷ আন্দোলন দমনে লাঠিয়াল বাহিনী নামিয়ে, শিশু-কিশোরদের, সাংবাদিকদের পেটানোর ছবিতে দেশের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ এই দায় কার? যারা ছবি তুললেন- প্রকাশ করলেন, তাদের? না যারা পেটালেন, যারা পেটাতে দিলেন তাদের?
শহীদুল আলমকে গ্রেফতার করায় পৃথিবীর প্রখ্যাত মানুষেরা যে বাংলাদেশকে চিনলেন, তাঁদের বিবৃতির মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবী যেভাবে চিনল-জানল, তার দায় কী সরকার এড়াতে পারবে?
বাস্তবতা অস্বীকার করে ‘গুজব' আর ‘উসকানিমূলক' বক্তব্যের পেছনে সময় ব্যয় করা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে?