আফগানিস্তানে শিশুশ্রম
১৯ জুন ২০১৩আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে চার বছর ধরে ছুতারের কাজ করছে সাত্তার৷ অনেক কষ্ট করে কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল সে৷ কিন্তু ক্লাস সিক্সের পর আর এগুনো সম্ভব হয়নি৷ তাও কয়েক বছর হয়ে গেল৷ ‘‘আমার পরিবারকে সাহায্য করতে হয়৷ আমার পরিবার এত গরিব না হলে স্কুল ছাড়তে হতো না৷ আমি তো কিছু শেখার জন্য স্কুলে যেতে চাই৷'' জানায় সাত্তার৷
সাত্তার দৈনিক ১০০ আফগানি অর্থাৎ ১.৪০ ইউরো রোজগার করে৷ ১০ সদস্যের পরিবারটিকে সাহায্য করার জন্য বাধ্য হয়েই কাজে নামতে হয়েছে এই কিশোরকে৷ তার বাবার বয়স হয়েছে অনেক৷ তাই পরিবারের ভরণপোষণ করতে পারেন না তিনি৷
শিশুশ্রম বিস্তৃত
আফগানিস্তানের শ্রম ও সমাজ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ আলি এফতেখারির অনুমান, আফগানিস্তানে ১৮ বছরের কম ১২ লক্ষের মতো শিশু ও কিশোরকে কাজ করতে হচ্ছে৷ তবে এ ব্যাপারে কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই৷ জাতিসংঘের শিশুকল্যাণ সংস্থা ইউনিসেফ-এর মতে আফগানিস্তানে শিশুশ্রমের হার অনেক বেশি৷ ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সি ছেলে-মেয়ের মধ্যে ১৭ শতাংশ মেয়ে ও ৯ শতাংশ ছেলে কাজ করে থাকে৷
শিশু অধিকার রক্ষা সংগঠন ‘সেভ দ্য চিলড্রেন জার্মানি'-র ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাট্রিন ভিলান্ড এই পরিসংখ্যান বাস্তবসম্মত বলে মনে করেন৷ তাঁর মতে, এমনকি চার থেকে ছয় বছর বয়সি শিশুদেরও কাজ করতে হচ্ছে৷ অবশ্য বয়সটা অনুমান করেই বলতে হয়, জানান ভিলান্ড৷ ‘‘কেননা মাত্র ৬ শতাংশ বাচ্চার জন্মের সার্টিফিকেট রয়েছে৷ এছাড়া শিশুশ্রম বিশেষ করে মেয়েদের বেলায় অনেকটা গোপনেই হয়ে থাকে৷''
ছেলেরা রাস্তায় জিনিসপত্র ফেরি করে কিংবা আবর্জনা কুড়ানোর কাজ করে থাকে৷ যেমন কৃষিখেতে ও জীবজন্তুর খামারে৷ মেয়েরা কার্পেট বোনা ও মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করে৷ অনেকে আবার ইটের ভাটায় সাহায্য করে৷ এই জায়গায় কাজ করাটা খুব বিপজ্জনক৷ কাটাছেড়া ও পোড়ার ঝুঁকি তো রয়েছেই৷ ঘন সিসার কারণে দৃষ্টিও হারাতে পারে শিশুরা, ক্ষতি হতে পারে হাড়ের জয়েন্টের৷ ইটের ভাটার অর্ধেক শ্রমিকের বয়সই ১৪ বছরের কম৷ শিশুদের নিয়ে ব্যবসাও মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে আফগানিস্তানে৷ এছাড়া তালিবানরা বাচ্চাদের আত্মঘাতী হামলায় কাজে লাগাচ্ছে৷
মূল কারণ দারিদ্র্য
আফগানিস্তানে শিশুশ্রমের মূল কারণ দারিদ্র্য৷ এছাড়া অনেক বাচ্চাই এতিম কিংবা পিতৃহারা৷ কয়েক দশক ধরে যুদ্ধের ফলাফল৷ শিশুশ্রম এইভাবে চলতে থাকলে তা সমাজের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বয়ে আনবে বলে মনে করেন শিশু অধিকার বিশেষজ্ঞ ভিলান্ড৷ তাঁর মতে, ‘‘শিশুরা স্কুলে না গেলে একটি চক্রের মধ্যেই ঘোরপাক খেতে থাকবে৷ দারিদ্র্য থেকে বের হতে পারবে না৷ অনেক বাচ্চাই এই ধরনের কাজ করতে করতেই শরীর শেষ করে ফেলে৷ এরপর ভালো কোনো কাজ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না৷ শেষ পর্যন্ত ভিক্ষা বৃত্তিকেই বেছে নিতে হয় তাদের৷''
আফগানিস্তানের নিরপেক্ষ মানবাধিকার কমিশনের শামসুল্লাহ আহমাদজাই সমালোচনা করে বলেন, সরকার জাতিসংঘের শিশু কনভেনশনে স্বাক্ষর করলেও শিশু অধিকার রক্ষার ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করছে না৷ শিশু শ্রমিকদের জন্য সাহায্য প্রকল্পগুলি এক বছর পর্যন্ত চলে৷ তারপর শিশু শ্রমিকরা আবার তাদের আগের কাজে ঢোকে৷ ‘‘সরকারের উচিত বাচ্চাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়া৷ কিন্তু বিদ্রোহীদের দমন করতেই ব্যস্ত শাসনযন্ত্র৷''
‘সেতু-স্কুল'-এর সাফল্য
শিশুরক্ষা সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন' আফগানিস্তানের নয়টি প্রদেশে তথাকথিত ‘সেতু-স্কুল' গড়ে তুলেছে৷ কাজের পর এই সব স্কুলে যাওয়ার সুযোগ-সুবিধা পায় বাচ্চারা৷ পায় একবেলা গরম খাবার৷ এতে করে কাজ করার পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে পারে শিশুরা৷ এইভাবে সংগঠনটি ৩২,০০০ বাচ্চাকে সাহায্য করছে৷
কিশোর সাত্তারও এই প্রকল্পে অংশ নিতে চায়৷ তার ভাষায়, ‘‘আমার অবস্থা ভালো থাকলে, লেখাপড়া শিখতে পারলে একটু ভালো জীবনও আমার হতো৷''
সরকারের কাছে তার দাবি, শিশুদের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ-সুবিধা করে দেওয়ার৷ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিশুশ্রম কমানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নিতে হবে৷ শুধু এইভাবেই সাত্তারের মতো শিশু কিশোররা প্রশিক্ষণ নিয়ে সঠিক পেশায় যোগ দিতে পারবে৷