পশ্চিমবঙ্গে এনসেফেলাইটিস!
৪ আগস্ট ২০১৪রোগ সংক্রমণ ঠিক কতটা ছড়ালে, সেই রোগে ঠিক কতজনের মৃত্যু হলে তাকে মহামারী বলে ঘোষণা করা যাবে, সেই সংক্রান্ত নির্দিষ্ট বিধি-নিষেধ আছে৷ প্রতিবার সেই নিয়মের ফোঁকর গলেই রেহাই পেয়ে যায় পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য দপ্তর৷ নয়ত প্রতি বছর নিয়ম করে বর্ষাকাল থেকে একে একে শুরু হয় এনসেফেলাইটিস, ডেঙ্গু এবং ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগ৷ প্রতি বছরই শতাধিক রোগী, বিশেষ করে শিশুরা মারা যায় এইসব রোগে৷
এবারেও যেমন উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে প্রথম ছড়াল এনসেফেলাইটিসের সংক্রমণ৷ অবশ্য জানুয়ারি মাস থেকেই উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে জাপানি এনসেফেলাইটিসের উপসর্গ নিয়ে রোগীরা আসছিলেন৷ কিন্তু তখনই সচেতন হয়নি রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর৷ ফলে এক জুলাই মাসেই ৩০৪ জন জ্বর ও অন্যান্য রোগলক্ষণ নিয়ে ভর্তি হন উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে, যাঁদের মধ্যে ১৫৪ জনের জাপানি এনসেফেলাইটিস ধরা পড়েছে৷ এর আগের ছ'মাসে আরও ৫৪ জন রোগীর দেহে এই রোগের জীবাণু পাওয়া গিয়েছে৷ আর ২৭ জন নিশ্চিতভাবে মারা গিয়েছেন এই রোগে, সেটাও কেবল উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে৷
কিন্তু উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের কারও জাপানি এনসেফেলাইটিস হয়েছিল কিনা জানার উপায় নেই৷ কারণ মেরুদণ্ডের শেষাংশ থেকে সংগ্রহ করা সেরিব্রো-স্পাইনাল ফ্লুইড পরীক্ষা করে রোগ শনাক্ত করার যে পদ্ধতি, তার জন্য প্রয়োজনীয় কিট-ই নেই জেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে৷ ফলে সেখানে যেসব রোগী ভর্তি হচ্ছেন, তাঁদের রক্তের নমুনা পাঠাতে হচ্ছে উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে৷ তার রিপোর্ট আসতে অনেক দেরি হচ্ছে, যেহেতু মেডিকেল কলেজেও রোগীর প্রবল চাপ৷ ততদিনে হয়ত আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়েছে!
সরকারের পদক্ষেপ
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য কর্তব্যে গাফিলতি এবং সরকারকে সময়মত তথ্য না দেওয়ার দায়ে উত্তরবঙ্গের স্বাস্থ্যকর্তাকে সাসপেন্ড করে তাঁদের জায়গায় নতুন লোক বসিয়েছেন৷ যুদ্ধকালীন তৎপরতায় উত্তরবঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তাঁর স্বাস্থ্য দপ্তর এর জন্যে আদৌ তৈরি নয়৷ বরং তথ্য-পরিসংখ্যান এবং নিয়মনীতির সুযোগ নিয়ে পরিস্থিতি হালকা করে দেখানোর একটা চেষ্টা রয়েছে৷ অথচ উত্তরবঙ্গের পর এখন দক্ষিণবঙ্গেও এনসেফেলাইটিস ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে৷ খাস কলকাতা শহরেও অ্যাকিউট এনসেফেলাইটিসের লক্ষণ নিয়ে রোগীরা ভর্তি হচ্ছেন মেডিকেল কলেজগুলি-সহ বিভিন্ন হাসপাতালে৷ পাশাপাশি ম্যালেরিয়ার প্রকোপের কথাও শোনা যাচ্ছে৷
দায়ী শুয়োর
এই পরিস্থিতেতে হাওড়া এবং কলকাতায় পুরসভা ও পুলিশের যৌথ উদ্যোগে যে শুয়োর ধরা অভিযান চলছে, তা কার্যত এক হাস্যকর প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ জঞ্জালের গাদায় ঘুরে বেড়ানো শুয়োর ধরার নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য সরকার কারণ জীববিজ্ঞানীরা বলছেন, শুয়োরের দেহ থেকেই জাপানি এনসেফেলাইটিসের জীবাণু আসছে মশার রক্তে এবং সেই মশা মানুষকে কামড়ালে রোগ ছড়াচ্ছে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, শুয়োর পাকড়াও করা যে মোটেই সহজ কাজ নয়, কাজে নেমে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন এ ব্যাপারে কোনও অভিজ্ঞতা বা তালিম না থাকা পুরকর্মীরা৷ ফলে সারাদিন শুয়োরের পিছনে দৌড়ে বেড়িয়ে হয়তো গুটি কয়েক শুয়োরকে কব্জা করতে পারছেন তাঁরা৷
ওদিকে শুয়োর ধরার পর পুরসভার খোঁয়াড়ে তাদের যেভাবে ফেলে রাখা হচ্ছে, অনেক সময় খাবার বা জল ছাড়াই, সে নিয়ে জোরালো আপত্তি তুলছেন পশুপ্রেমীরা৷ শুয়োরের মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার, সে ব্যাপারেও কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে না৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সরকারি হাসপাতালের মর্গ বা লাশকাটা ঘরের দায়িত্বে থাকেন যাঁরা, তাঁদের বেশিরভাগেরই পোষা শুয়োর থাকে৷ কাজেই হাসপাতালের জঞ্জালের গাদায় শুয়োর ঘুরে বেড়াচ্ছে, এ প্রায় নিয়মিত দৃশ্য! সেই জঞ্জাল নিয়মিত পরিস্কার করে হাসপাতাল চত্বর সাফসুতরো রাখা হচ্ছে, এমনটা প্রায় চোখেই পড়ে না৷ শহরের বুকে খোলা ভ্যাটে উপচে পড়া জঞ্জালও রোজকার দৃশ্য৷ কিন্তু যখন এই এনসেফেলাইটিস ছড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনা ঘটে, দোষ হয় বেচারা শুয়োরদের!