1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আবাস যোজনার প্রাপক তালিকা নিয়ে ক্ষোভ

পায়েল সামন্ত পশ্চিমবঙ্গ
১ নভেম্বর ২০২৪

জেলায় জেলায় আবাস যোজনা প্রাপকদের তালিকা ফের যাচাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে। এনিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা।

https://p.dw.com/p/4mTmQ
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ছবি: Prabhakar Tewari/DW

আবাসের তালিকা আর একবার যাচাইয়ের নির্দেশ দিয়েছে নবান্ন। এই নির্দেশ বিভিন্ন জেলায় পৌঁছেছে সম্প্রতি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০ ডিসেম্বর থেকে এই প্রকল্পের প্রথম দফার টাকা প্রাপকদের দিতে চান। লোকসভা নির্বাচনের আগে এমনটাই প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। সেই কারণে ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে সমীক্ষা শেষ করে তালিকা চূড়ান্ত করতে বলা হয়েছে। এই পুনর্মূল্যায়নের জেরে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ।

নতুন করে সমীক্ষা

গরিব মানুষের মাথার উপর ছাদ নির্মাণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্প চালু হয়। এই প্রকল্পে সমতল এলাকার বাসিন্দাকে ১ লক্ষ ২০ হাজার ও পাহাড়, আদিবাসী, পিছিয়ে পড়া জেলার বাসিন্দাদের মাথাপিছু ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা দেয়া হয়।

এই প্রকল্পের চূড়ান্ত ও সংশোধিত তালিকা প্রস্তুত করার কাজ শুরু হয়েছে রাজ্যে। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রাপকদের যাচাইয়ের কাজ করতে হবে, তাও স্পষ্ট করা হয়েছে নবান্নের নির্দেশিকায়।

প্রধানত ২০২২-২৩ সালে আবাসের সংযোজিত তালিকায় যাদের নাম ছিল  এবং ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের এই প্রকল্পের টাকা দেয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, কোন বিষয়গুলি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। তালিকায় নাম ছিল অথচ বাদ গিয়েছে, সেক্ষেত্রে আবেদন ফের যাচাই করে দেখতে হবে। কাঁচা বাড়ি অথচ ইট-সিমেন্টের দেয়াল রয়েছে যাদের, তাদের নাম আগে বাদ থাকলে সেই বিষয়টি ফের বিবেচনা করতে হবে। এমন বেশ কয়েকটি নির্দেশের ভিত্তিতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ চলছে।

সমীক্ষা নিয়ে ক্ষোভ

এই সরকারি প্রক্রিয়ার মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষ তালিকা নিয়ে ক্ষোভ দেখাচ্ছেন। সমীক্ষা শুরু হওয়ার পর থেকেই যোগ্য প্রাপকদের তালিকা থেকে নাম বাদ যাওয়া ও প্রকল্প ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ ক্রমশ বাড়ছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের নাম।

নদীয়ার তেহট্টে গ্রাম পঞ্চায়েতের সাবেক তৃণমূল প্রধান ও উপপ্রধানের বিরুদ্ধে প্রকল্পে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। ব্লক উন্নয়ন আধিকারিকের কার্যালয়ে কয়েকজন গ্রামবাসীর অভিযোগ জমা পড়ে। এ নিয়ে চলতি সপ্তাহে বিক্ষোভ হয়েছে।

মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুর-২ ব্লকে আবাস যোজনার তালিকা করতে গিয়ে গ্রামবাসীদের ক্ষোভের মুখে পড়েছেন আধিকারিকরা। আবাস যোজনার সমীক্ষক দলকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখা গিয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার পাঁচরোল এলাকায়।

সমীক্ষকরা কাজ করতে গেলে স্থানীয়রা বাধা দেন। উভয় পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়।

সমীক্ষার শুরুতেই উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গায় গ্রামবাসীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন সরকারি আধিকারিক ও জনপ্রতিনিধিরা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার রায়দিঘিতে বিডিও অফিস ঘেরাও করেন গ্রামবাসী। বীরভূমের রামপুরহাট-২ ব্লকের বিডিও অফিসের সামনেও একই ছবি দেখা গিয়েছে।

আলিপুরদুয়ারের কুমারগ্রামে আবাস যোজনার তালিকায় একটি আদিবাসী পাড়ায় ৪৪টি পরিবারের কারো নাম ওঠেনি বলে অভিযোগ। যোজনার তালিকা নিয়ে অন্ডাল, গোঘাট, পাথরপ্রতিমা, পুরুলিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষোভের আঁচ।

এইসব অভিযোগ সামনে আসায় গত বুধবার মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। প্রকল্পের প্রাপকরা যাতে নিজেদের বঞ্চিত না ভাবেন, সেটা নজর রাখার কথা বলা হয়েছে প্রত্যেক জেলার সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে।

মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "এই রি-ভেরিফিকেশন নিয়ে অকারণে কেউ বিচলিত হবেন না। ইতিমধ্যে কেউ পাকাপাকি বাড়ি করে ফেলেছেন কিনা বা অন্যত্র চলে গিয়েছেন কিনা সেটা দেখতে এই সমীক্ষা। তালিকাভুক্ত উপযুক্ত সকলেই সহায়তা পাবেন।"

কেন্দ্রের শর্ত বদল

প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে যা কেন্দ্রীয় সরকার নির্ধারিত করেছে। পরিবর্তিত নিয়মে মোটর বাইক, মোটরচালিত মাছ ধরার নৌকা, রেফ্রিজারেটর, ল্যান্ড ফোন থাকলে এবং মাসিক আয় ১৫ হাজার টাকা হলেও সংশ্লিষ্ট পরিবার আবাস প্রকল্পের সুবিধা পেতে পারে।

এছাড়া শর্তের মধ্যে রয়েছে, তিন অথবা চার চাকার গাড়ি থাকলে, ৫০ হাজার টাকা বা তার বেশি অঙ্কের কিষান ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা পেলে, সরকারি বা অন্য কোনো সংস্থায় কাজ করলে নাম বাদ যাবে।

পরিবারের কোনো সদস্যের আয় আয়করের আওতাধীন হলে, আড়াই একর বা তার বেশি জমির মালিকানা থাকলে প্রকল্পের সুবিধা পাওয়া যাবে না।

রাজ্য সরকার এসব শর্তকে ততটা গুরুত্ব দিতে রাজি নয়। তাদের সিদ্ধান্ত, প্রকল্পের সুবিধা বিতরণের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি হবে মানবিক। মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ, প্রকৃত প্রাপকরাই যেন বাড়ি পান, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কেউ যেন কেন্দ্রের শর্তের আইনি বাধায় প্রকল্প থেকে বঞ্চিত না হয়, সেটা দেখতে বলা হয়েছে জেলা প্রশাসনকে।

দলবাজির অভিযোগ তুলে বিরোধীরা প্রচার চালালেও খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না: সুমন ভট্টাচার্য

কেন্দ্র ও রাজ্যের বিরোধ

আবাস যোজনা প্রকল্পের তালিকায় ভুয়ো নাম থাকার অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা। এমন দাবি করে কেন্দ্র প্রায় দু'বছর এই প্রকল্প খাতে পশ্চিমবঙ্গের বরাদ্দ আটকে রেখেছে বলে অভিযোগ। রাজ্যের দাবি, তারা নিজেদের বরাদ্দ থেকে গ্রামীণ এলাকায় গরিব মানুষের বাড়ি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।

আলাপনের বক্তব্য, "আবাস যোজনায় কেন্দ্রের ৬০ শতাংশ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও তারা দেয়নি। তাই রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাড়ি তৈরির জন্য টাকা দেয়া হবে। এই কারণে উপভোক্তাদের তালিকা তৈরির জন্য সমীক্ষা এতটা সময় ধরে করা হচ্ছে।"

দুর্নীতির অভিযোগ খারিজ করে দিচ্ছে শাসক দল। তারা বলছে, নতুন তালিকায় তৃণমূলের অনেক নেতা, সমর্থকের নাম বাদ পড়তে চলেছে। প্রকল্পের সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো দলভেদ করা হচ্ছে না।

তৃণমূলের বিরুদ্ধে অতীতে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তার প্রভাব সেভাবে নির্বাচনে দেখা যায়নি। ১৩ নভেম্বর রাজ্যের ছয়টি কেন্দ্রে উপনির্বাচন। তাতে কি দুর্নীতির অভিযোগ তোলা বিরোধীদের কোনো রাজনৈতিক সুবিধা হবে?

সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, "আবাস যোজনা নিয়ে অভিযোগে তৃণমূল কতটা বিপাকে পড়তে পারে, সেটা উপনির্বাচনের ফলে বোঝা যেতে পারে। তবে দুর্নীতির অভিযোগে এর আগে তেমন সমস্যা হয়নি শাসক দলের। এবার রাজ্য সরকার সতর্ক রয়েছে। সঠিক উপভোক্তা যাতে প্রকল্পের সুবিধা পান, বাকিদের নাম বাদ পড়ে, সেটা নিশ্চিত করতে প্রশাসন বেশ তৎপর। তাই এ নিয়ে দলবাজির অভিযোগ তুলে বিরোধীরা প্রচার চালালেও খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না।"

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিজেপি নেতা অধ্যাপক বিমলশংকর নন্দ ডিডাব্লিউকে বলেন, "দুর্নীতি জনমতের উপর প্রভাব ফেলে না এটা ভুল ধারণা। এখানে প্রভাবটা ফেলতে দেওয়া হয় না বলেই ভোটে জালিয়াতি হয়।"

তার মতে, "পশ্চিমবাংলার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ মানুষ অত্যন্ত দীন জীবনযাপন করে। তাদের কাছে সরকারি সাহায্য গুরুত্বপূর্ণ। সেই সরকারি সাহায্য দিয়ে তাদের নির্বাচনী আচরণ প্রভাবিত করার চেষ্টা করে শাসক দল।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷