‘‘আমরা ঘুমিয়ে থাকলে তো ওরা সবই নিয়ে যাবে''
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪বিবি রাসেল, বিবি প্রডাকশনস-এর প্রতিষ্ঠাতা৷ বাংলাদেশের নিজস্ব পোশাক, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য তুলে ধরছেন সারা বিশ্বে৷ তার সঙ্গে ডয়চে ভেলের আলাপচারিতা তুলে ধরা হলো এখানে:
ডয়চে ভেলে: ভারত টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই সনদ কীভাবে পেল? ভারত কি পেতে পারে? এখানে বাংলাদেশের করণীয় কী?
বিবি রাসেল: আসলে আমি তো আশ্চর্য হয়ে গেছি৷ আমি দুই সপ্তাহেরও কম হবে ভারতের ওই এলাকায় কাজ করে এলাম৷ টাঙ্গাইল শাড়ি একটি জায়গার নামে৷ খুব কম শাড়িই আছে জায়গার নামে৷ জামদানিও কোনো জায়গার নামে নয়৷ যদিও ওটার জিআই আমরা পেয়েছি৷ এটাতো (টাঙ্গাইল শাড়ি) দুইশ বছর আগেকার৷ টাঙ্গাইলে নদী আছে৷ যমুনা নদী, ধলেশ্বরী নদী৷ ওখানকার একটা জীবন ধারা৷ পার্টিশনের আগে কিছু লোকজন চলে গেছে৷ প্রধানত বসাকেরা৷ একাত্তরের পরেও কিছু গেছে৷ আপনি চলে যেতে পারেন, মাইগ্রেট করতে পারেন৷ কিন্তু আপনি তো নদী, আবহাওয়া, বাতাস সব নিয়ে চলে যাবেন না৷ পশ্চিমবঙ্গের ওই এলাকায় কোনো জায়গাই নাই যেটার নাম টাঙ্গাইল৷ এটা আমি চিন্তাও করতে পারিনি যে ভারত এটা পেতে পারে৷ ভারত কেমন করে পেয়েছে? কিন্তু আমরা কেন এটার জন্য আবেদন করলাম না৷আমরা তো মাত্র এখন করলাম৷
ডয়চে ভেলে: আমাদের এখন কী করণীয়?
আমি পজেটিভ চিন্তা করি৷ আমরা যদি সঠিক পদ্ধতিতে এখন আবেদন করি, প্রতিবাদ করি তাহলে কাজ হবে৷ প্রতিবাদ কিন্তু শুরু হয়ে গেছে৷ আমি নিজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তেমন আসি না৷ এই বিষয়টি নিয়ে আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসছি৷ চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে যে, ওরা কেন এটা পেল৷ আমরা কিন্তু যুক্তি দেখিয়ে এটা আমরা ফিরিয়ে আনতে পারি৷ আমাদের পক্ষে সবই আছে৷ জিআই, আপনি নিজেই বলেছেন, জিআই হলো ভৌগোলিক নির্দেশক, জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন৷ এটা তো ওদের নই৷ ওখানে কি ধলেশ্বরী নদী, যমুনা নদী আছে? তাঁতীরা সকালে উঠে কেমন করে সুতা শুকায়, মাড় দেয় , ওদের জীবনযাপন৷ এটাতো ওদের(ভারতের) পাওয়ার কোনো সুযোগই নাই৷ কিন্তু কেমন করে পেল? সব দিক দিয়ে প্রতিবাদ আসছে৷ সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করছে৷ সরকারকে তো এটা নিয়ে লড়তে হবেই৷
ডয়চে ভেলে: এখন যে বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই সনদ দেয়ার কথা বলছে৷ এটা হলেই কি বাংলাদেশ জিআই সনদ পেয়ে গেল?
আমি অনেকবারই বলেছি৷ আমি ঘুমিয়ে থাকলাম আর ওরা করে ফেলেছে৷ এটা নিয়ে মানুষের মধ্যে কিন্তু কনফিউশন আছে৷ এটা সরকার জিআই আইনে চিহ্নিত করেছে৷ কিন্তু তারপর তো ডাব্লিউটিওতে (বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা) যেতে হবে৷ সেখানে আমার মনে হয় আমাদের ঘুমিয়ে থাকলে হবে না৷ আমাদের জিনিস অন্যরা ছিনতাই করে নিয়ে যাবে আর আমরা চুপ৷ আমরা কোনো প্রতিবাদই করলাম না৷ আমাদের অনেক যুক্তি আছে৷ পয়েন্ট আছে৷ জিআই ল এর সবই আমাদের পক্ষে ৷ কিন্তু আমাদের প্রটেস্ট করতে হবে৷ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে প্রটেটেস্ট করতে হবে৷
ডয়চে ভেলে: ভারত তো ৬৬টি পণ্যের জিআই সনদ নিয়েছে৷ তারা নকশিকাঁথাসহ আরো কিছু পণ্যের জিআই সনদ নিয়েছে৷ এখন কি শুধু টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে প্রতিবাদ করলে হবে, না অন্য পণ্য নিয়েও কাজ করতে হবে?
না না, সব বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে৷ দেখেন বাংলাদেশ একটা ছোট দেশ৷ ভারত অনেক বড় দেশ৷ ওদের প্রত্যেকটা প্রদেশে কিছু না কিছু আছে৷ আমাদের তো অল্প কয়টা জিনিস৷ কিন্তু আমরা নিজেরাই যতি সতর্ক না হই তাহলে কীভাবে হবে? আমরা এতদিন পর বলছি টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই চিহ্নিত করেছি৷ এটা তো সবার আগে করা উচিত ছিল৷ আমি নিজে ১০ বছর বয়স থেকে শাড়ি পরা শিখেছি, টাঙ্গাইল শাড়ি৷ প্রত্যেকটা ঘরে ঘরে টাঙ্গাইল শাড়ি আছে৷ টঙ্গাইল শাড়ি সবার জন্য৷ জামদানির দাম একটু বেশি, সবাই কিনতে পারে না৷ কিন্তু টাঙ্গাইল শাড়ি সবার ঘরে ঘরে৷ বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে৷
ডয়চে ভেলে: আমরা বাংলাদেশের ইলিশ পেয়েছি৷ ভারত পেয়েছে গঙ্গার ইলিশ৷ ঐতিহাসিক এবং ভৌগোলিক কারণে কিছু পণ্য আবার দুই দেশে মিলে মিশে আছে৷ এখন ভারত যদি এককভাবে সেইসব পণ্যের জিআই সনদ নিয়ে নেয় তাহলে আমাদের কী করতে হবে?
ধরেন আপনি আমাকে ইন্টারভিউ নিচ্ছেন৷ আপনি জানেনই না কী প্রশ্ন করবেন৷ যারা এগুলোর কনসার্ন ডিপার্টমেন্ট তাদের এগুলো টু দ্য পয়েন্টে লিখতে হবে৷ ভারতের কিন্তু দক্ষ মানু্ষরা লিখছে৷ খালি বললেই হবে না টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের৷ কেন আমাদের, ইতিহাস কী, এগুলোর পরম্পরা কী,ঐতিহ্য কী এগুলো বলতে হবে৷ জিআই হলে একটি দেশ হিসেবে আমরা যখন পণ্য রপ্তানি করব এর রয়্যালিটি আমরা পাব৷ যেমন আমাদের পেঁয়াজ৷ ভারতেরও পেঁয়াজ আছে৷ তাদেরটা আমাদের বলছি না৷ কিন্তু আমাদেরটা আমাদের৷ ভারত পেঁয়াজ না দিতে পারে৷ দাম বাড়াতে পারে৷ কিন্তু তখন আমি আমার পেঁযাজ নিয়ে প্লে করতে পারি৷এটা আমদের পণ্য৷ এখন এটা যদি আমরা ছেড়ে দেই তাহলে তো হবে না৷ জিআই আমাদের দেশীয় পণ্য ব্র্যান্ডিংএ সহায়তা করে৷ আমাদের পণ্য বিশ্বে আমাদের নামে পরিচিত হবে৷
ডয়চে ভেলে: আমাদের আম, মিষ্টি এগুলো নিয়েওতো ভারত টান দিয়েছে৷
আমি জানি, রসগোল্লা করে ফেলেছে৷ কিন্তু ভাই আমার নামটা আমি ব্র্যান্ডিং করব৷ আমার নামটা যদি আরেকজন নিয়ে নেয় আর আমি ঘুমিয়ে থাকি, কোনো প্রটেস্ট না করি তাহলে ওরা তো একটার পর একটা নিতেই থাকবে৷
ডয়চে ভেলে: তাহলে কি আমরা আমাদের কাজের দিক থেকে পিছিয়ে আছি? এই ক্ষেত্রে ভারতকে মোকাবিলায় আমাদের দক্ষতা কি কম, আমরা কি পারছি ?
আমাদের না পারার তো কোনো কারণ নাই৷ আমাদের কাছে সব আছে৷ টাঙ্গাইল শাড়ির সব কিছু আমাদের তারপরও ওরা নেয় কীভাবে?
ডয়চে ভেলে: শুধু টাঙ্গাইল শাড়ির কথা বলছি না৷ আরো তো অনেক পণ্য আছে?
হ্যাঁ আছে৷ জায়গার নামে আমাদের আরো পণ্য আছে৷ যেমন রাজশাহীর সিল্ক৷ আমি দুইদিন পর সেখানে যাচ্ছি৷ এখন আমি তো এর জিআই সনদ নিতে পারি না৷ আমি যতই প্রতিবাদ করি না কেন কাজটা করতে হবে সরকারকে৷ আমাদের অনেক হস্তশিল্প আছে৷ জিআই সনদ একটি দেশের জন্য দেয়া হয়৷ তাই সব পণ্যের জন্যই কাজটি করতে হবে সরকারকে৷
ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশ এপর্যন্ত ২১টি পণ্যের জিআই-এর জন্য আবেদন করেছে৷ ১৪-১৫টি পেয়েছে৷ এগুলো কি যথেষ্ট? আমাদের পেটেন্ট, ডিজাইন, কপিরাইট ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তর আছে৷ তার কি ঠিকমত কাজ করছে?
তাদের তো অনেক বড় ডিপার্টমেন্ট৷ আমি যদি ছোট্ট একটা অফিস নিয়ে দেখাতে পারি যে বাংলাদেশের মানুষের হাতে যাদু আছে তাহলে তাদের তো আরো অনেক বেশি করা উচিত৷ করছে না কেন? যদি কোনো প্রয়োজন হয় আমরা তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পারি৷ সেটাও যদি না করে তাহলে তো আমাদের কিছু বলার নাই৷ কিন্তু আমিও ছেড়ে দেয়ার মেয়ে নই৷ সব দিক দিয়ে প্রতিবাদ শুরু হয়ে গেছে৷আমরা ঠিক মতো আবেদন করতে পারলে আমাদের টঙ্গাইল শাড়ির জিআই অবশ্যই ফিরে আসবে৷ আপনারা সবাই প্রতিবাদ জারি রাখুন৷ তা না হলে আমার মনটা একদম ভেঙে যাবে৷
ডয়চে ভেলে: সার্বিকভাবে আমাদের পণ্যের জিআই নিয়ে আাপনার পরামর্শ কী?
আমাদের পণ্য সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে৷ কারণ জিআই সনদের জন্য সঠিক তথ্য উপাত্ত দিয়ে আবেদন করতে হয় নিয়ম মেনে৷ নিয়ম, আইন জানতে হয়৷ যেমন, আমি অনেক দিন ইটালি ছিলাম৷ আমি এখন ইটালিয়ান পাস্তা ভালো বানাতে পারি৷ এদেশে এসে সেই পাস্তা আমি বানাচ্ছি৷ তাই বলে সেটা আমার হয়ে গেল না? এটা ইটালিয়ান পাস্তা৷ই৷ আমাদের যারা এর দায়িত্বে আছেন তাদের সঠিকভাবে আবেদন করতে হবে৷ আমাদের পণ্যের তালিকা করে টু দ্য পয়েন্ট, রাইট পয়েন্টে লিখতে হবে৷
আমাদের অনেক পণ্য আছে সেগুলোর জিআই সনদ আমাদের পাওয়া উচিত৷ কিন্তু...