শোক ও সংহতি
১২ জানুয়ারি ২০১৫রবিবারের ব়্যালি দেখে বাকি বিশ্বের ঈর্ষা হলেও আশ্চর্যের কিছু থাকত না৷ গত সপ্তাহের রক্তাক্ত ঘটনাবলীর পর ফরাসিরা তাদের ইতিহাস ও মূল্যবোধ, জাতি তথা আদর্শের প্রতি চমকপ্রদ আনুগত্য দেখিয়েছেন৷ প্যারিসে মিছিল করেন ১৫ লক্ষের বেশি মানুষ – বাকি দেশে আরো বিশ লাখ৷ তারা গণতন্ত্রের সপক্ষে এবং হিংসা ও ভীতির বিপক্ষে আন্দোলন করেন৷ সন্ত্রাসী হামলায় ভয় পেতে রাজি নন তারা, এবং সেই মহার্ঘ বস্তুটি হারাতে রাজি নন, যা তাদের কাছে অতি প্রিয়: মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ফ্রান্সের প্রাচীনতম ঐতিহ্যগুলির মধ্যে পরিগণ্য, জাতীয় সত্তার অঙ্গ৷
সংহতি মাঝেমধ্যে কিছুটা উদ্ভট
চল্লিশটি দেশের রাষ্ট্র তথা সরকারপ্রধানেরা প্যারিসে এসেছিলেন, ফ্রান্সের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে – এবং তাদের বিপুল করতালি দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয়৷ সেক্ষেত্রে একই পঙক্তিতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু এবং ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে দেখতে পাওয়াটা চমকে যাওয়া মতো – যদিও নেতানিয়াহু কোনোরকম প্রতীকী আচার-আচরণের মাধ্যমে শান্তির ইঙ্গিত রাখেননি৷ বরং তিনি ফ্রান্সের ইহুদিদের প্রতি বাস উঠিয়ে ইসরায়েলে যাবার আহ্বান জানিয়েছেন৷ রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ যখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেট্রো পোরোশেঙ্কোর সঙ্গে একই পঙক্তিতে পদযাত্রা করছিলেন স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সমর্থনে, তখন তিনিই বা কী ভেবেছিলেন? এ সব ব্যাপার-স্যাপার ক্ষেত্রবিশেষে উদ্ভট কিংবা হাস্যকর মনে হতে পারে৷
‘‘সারা বিশ্ব উঠে দাঁড়িয়েছে'', এই ছিল বিভিন্ন ফরাসি পত্র-পত্রিকার শীর্ষক, সঙ্গে মেশানো ছিল কিছুটা গর্ব, কেননা এই রবিবার ফ্রান্সের উপরে ছিল সারা বিশ্বের মনোযোগ৷ ফরাসিরাও চাইছিল বহির্বিশ্ব থেকে স্বীকৃতি ও সমর্থন৷ ফরাসিদের চোখে বুনিয়াদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষায় তারাই সর্বাগ্রে, অপরদিকে তাদের শঙ্কা, স্বদেশের সন্ত্রাসবাদীরা আবার আঘাত হানতে পারে৷ ব্রিটেনের মতো ফ্রান্সেও শহরের প্রান্তে ‘ঘেটো' এলাকাগুলিতে ইসলামি উগ্রপন্থিদের গুপ্তপ্রতিরোধ দানা বেঁধেছে এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, বলে মনে হতে পারে৷
ফ্রান্সের যৌথ সত্তা
বিগত কয়েক দিনে মানবতা এবং নাগরিক চেতনার নানা সংবেদনশীল নিদর্শন রাখা হয়েছে – যেমন একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘‘আমি শার্লি এব্দো, আমি একজন পুলিশ, আমি এক ইহুদি''৷ ফ্রান্সের সর্বত্র মানুষজন তাদের এই যৌথ সত্তার প্রতি আনুগত্য জানিয়েছে৷ কিন্তু এই আবেগের পর আবার একটু স্থির হলে রাজনৈতিক বিরোধও আবার ফিরে দেখা দেবে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী পরস্পরের উপর দোষারোপ করবে এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলী থেকে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবে৷
সেক্ষেত্রে প্রথমেই যার প্রয়োজন, তা হলো উত্তর আফ্রিকার দেশগুলি থেকে আগত অভিবাসীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন সম্পর্কে আন্তরিক আলাপ-আলোচনা৷ বিগত দশকগুলিতে যে সব ভুল করা হয়েছে: শহরের প্রান্তে হাই-রাইজ বসতির অরাজকতা, নিকৃষ্ট সব স্কুল, কোনোরকম ভবিষ্যৎবিহীন এক যুব সমাজ, যারা নিজেদের এ দেশের বাস্তবিক অংশ বলে মনে করে না; সেই সঙ্গে এমন সব নিকৃষ্ট কারাগার, যেগুলি উগ্রপন্থি রংরুট বানানোর কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে৷
এ ধরনের বেশ কয়েক লাখ মানুষের জীবনধারা স্থায়ীভাবে উন্নত করার জন্য ফ্রান্সের একটি সুবিশাল সংস্কার পরিকল্পনার প্রয়োজন পড়বে৷ সেক্ষেত্রে চরম দক্ষিণপন্থিদের তরফ থেকে বাধা আসবে বৈকি৷ শেষমেষ হয়ত বিগত কয়েক দিনের আবেগপূর্ণ গালভরা কথার পর আগের মতোই শুধু একটি বিনষ্ট সুযোগই পড়ে থাকবে৷