আমাদের চলচ্চিত্রচর্চার হকিকত
৬ জুন ২০১৭কথাগুলো বলেছিলেন সুইডিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা ইঙমার ব্যার্গমান৷ একই রকম কথা পরে আমরা স্লোভেনিয়ার দার্শনিক স্লাভয় জিজেকের মুখেও শুনেছি৷ তিনি বলছেন, চলচ্চিত্র এমন এক বস্তু যা আপনার সামনে বাসনার বস্তুকে হাজির করে না, বরং কী করে বাসনা করতে হয় সেটা শেখায়৷ যাঁরা ‘দ্য পারভার্ট'স গাইড টু সিনেমা' দেখেছেন, তাঁরা জিজেকের এসব কথা শুনেছেন৷ কাজেই বোঝা যাচ্ছে, চলচ্চিত্র বেশ জরুরি শিল্প৷
যেহেতু এই শিল্পের ক্ষমতা আছে মানুষের মনের সবচেয়ে গভীর অংশে ঢুকে পড়ার, তাই এই শিল্প নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের উচিত একে সঠিকভাবে ব্যবহার করা বা ব্যবহার করতে শেখা৷ চলচ্চিত্র নির্মাণ শুধু পরিচালকের একার দায় নয়, দায়িত্ব বর্তায় যাঁরা চিত্রনাট্য রচনা করেন, যিনি সম্পাদনা করেন, এমনকি যে লোকটি মেকআপ করে দেন তাঁর কাঁধেও৷ একা একা চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রায় অসম্ভব কর্ম৷
বাংলাদেশে ইদানিং চলচ্চিত্র নির্মাণের নানা কলাকৌশল নিয়ে তরুণরা আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে৷ এই আগ্রহের ফল মিলছে হাতেনাতেই৷ তাঁদের কাজ দেশের বাইরে বিভিন্ন উৎসবে প্রদর্শিত হচ্ছে, প্রশংসিত হচ্ছে, পুরস্কৃত হচ্ছে৷
তবে তাঁদের এসব কাজের বাইরেও বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের আরেকটি বড় জগত রয়েছে৷ এই জগতে বিরাজ করেন বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীরা৷ তাঁদের ছবি বাইরের দেশে উৎসবে যায় না৷ দেশের প্রেক্ষাগৃহই তাঁদের একমাত্র ভরসা৷ এই শিল্পের সঙ্গে সরাসরি জড়িত প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মতো মানুষ৷ এই মানুষগুলো বিভিন্ন সমিতিও গঠন করেছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন বা বিএফডিসির ভেতরে৷ প্রযোজক, পরিচালক, সহকারী পরিচালক ও শিল্পীদের এসব সমিতি যেহেতু ‘উন্নয়নের চত্বরে গঠিত হয়েছে, তাই ধরে নেয়া যায় চলচ্চিত্রের উন্নয়নই হওয়া উচিত তাঁদের অন্যতম লক্ষ্য৷ পরিতাপের বিষয়, আমরা জানতে পারি, তাঁরা ফি বছর শুধু নির্বাচন, আলোচনা সভা ও বনভোজনেই সীমাবদ্ধ থাকেন৷
সম্প্রতি আবার তাঁরা নিজেদের মধ্যে হামলা-মামলা নিয়েও ব্যস্ত সময় পার করছেন৷ মাঝে সমিতিগুলো কয়েকদিন ভারতীয় ছবি ঠেকানোর আন্দোলন করলেও, পরে শীর্ষ শিল্পীদের বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনার ছবিতে সুযোগ দেয়া হয়, তখন থেকে সেই আন্দোলনও স্তিমিত হয়ে আসে৷ আর বাংলাদেশ সরকারের নীতি নিয়ে না হয় কিছু না-ই বললাম৷ শুধু দুটি প্রশ্ন করি, কোন বিবেচনায় ভারতীয় ছবি দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির সিদ্ধান্ত নেয়া হলো? কেনইবা দেশি চলচ্চিত্রকে অসম একটি প্রতিযোগিতার ভেতর ফেলে দেয়া হচ্ছে?
প্রশ্ন থেকে পূর্বের আলাপে ফিরে যাই৷ এফডিসিতে দেখা যাচ্ছে দুই তিনটি কাজ বাদে চলচ্চিত্রের উন্নয়নে তেমন কোনো কাজ সমিতিগুলো করছে না৷ উন্নয়ন বলতে তাহলে কী বোঝায়? আমি অন্তত বুঝি—কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, সেমিনার ও দেশব্যাপী বিশেষ প্রদর্শনী, নিজেদের জন্য, দর্শকদের জন্য৷ বাংলাদেশে যে হারে ভারতীয় শিল্পী আনা হচ্ছে, সেটার সিকিভাগও যদি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষক বা পণ্ডিত আনা হতো, চলচ্চিত্রের নানা বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ ও সেমিনারের ব্যবস্থা করা হতো, যা অনেক সময় ছোট ছোট চলচ্চিত্র সংসদগুলো করে থাকে, তাহলে আমার অন্তত মনে হয়, চলচ্চিত্রের উন্নয়ন ঘটতো৷ এই কথায় প্রশ্ন উঠতে পারে, চলচ্চিত্রে কি তাহলে উন্নয়ন ঘটছে না? জবাবে বলবো, ঘটছে, তবে তা উল্লেখ করার মতো নয়৷ দেশের মানুষ এখন ‘আয়নাবাজি'র সিনেমাটোগ্রাফি, ‘আন্ডার কন্সট্রাকশন'-এর বহুস্তর বিশিষ্ট গল্প, ‘বাপজানের বায়স্কোপ'-এর মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী, বা ‘অজ্ঞাতনামা'র বক্তব্য বড় পর্দায় দেখতে পাচ্ছেন৷ উন্নতি আছে, একেবারে হচ্ছে না, তা বলা যাবে না৷ কিন্তু এই উন্নতি এফডিসির সমান্তরালে গড়ে ওঠা একদল চলচ্চিত্রকর্মীর হাত ধরে এগুচ্ছে৷ তাহলে এফডিসিকেন্দ্রিক, অর্থাৎ এফডিসিতে যাদের সমিতি আছে, তাঁদের নির্মিত চলচ্চিত্র এখনো কেন নায়ক আর খলনায়কে আটকে থাকছে? কেন এখনো গরিব নায়ক আর ধনী নায়িকার ফাঁদ থেকে বেরুচ্ছে না এসব ছবি? কেন এফডিসির ভিন্ন ছবি মানেই গ্রামীণ পরিবেশে প্রেম দেখাতে হবে? ষোলো সতেরো কোটি মানুষের দেশে গল্পের কি এতই আকাল?
এসব প্রশ্নের উত্তর হলো, এই মানুষগুলো যদি নিয়মিত শুধু ভারতীয় ‘কমার্শিয়াল' ছবি না দেখে, বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের ছবিও দেখতেন, সেসব নিয়ে নিয়মিত আনুষ্ঠানিক আলোচনা করতেন, ছবির নন্দনতত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করতেন, তাহলে আমার মনে হয়, এফডিসি যে বাজেটে শাকিব খানদের নিয়ে ছবি বানায়, ধরি দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা, সেই বাজেটের অর্ধেক দিয়েই আন্তর্জাতিক মানের ছবি বানানো সম্ভব হতো৷ দর্শক কী ‘খাবে', শুধু এটা চিন্তা করে ছবি বানালে চলবে কেন?
দর্শকের রুচি পরিবর্তনের দায়িত্বও তো এই প্রযোজক ও পরিচালকদের রয়েছে৷ জানি না এই বোধোদয় কবে ঘটবে! সহসা ঘটবে বলে মনে হয় না, কারণ, এফডিসিতে অবস্থিত পাঠাগারটি এখন শুনেছি চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির দখলে৷ সেখানে দুই-চারটি বই যা আছে, সেগুলো শুধু সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য৷ কেউ সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখার জন্যও নাকি ধরেন না৷ ধরবেন কিভাবে, সারা দেশেই পড়ালেখার প্রতি অনীহা রয়েছে৷ এ কারণেই চলচ্চিত্র বিষয়ক সাহিত্য যেমন অবহেলিত, তেমনি উপেক্ষিত যারা চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখি করেন৷ তবে সরকারিভাবে এই চলচ্চিত্র সাহিত্যকে গুরুত্ব দিলে আমার মনে হয় মানুষের চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ বাড়বে৷
তাছাড়া, লিখিত সাহিত্য ব্যাপারটি ছাড়া আসলে কোনো শাখাতেই জ্ঞানচর্চা করা সম্ভব নয়৷ বাংলাদেশে যে হারে চলচ্চিত্রের প্রতি তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে, সে হারে না হলেও, ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখালেখি বাড়ছে৷ প্রতি বছরই চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক একাধিক বই, জার্নাল ও ছোটকাগজ প্রকাশ হচ্ছে৷ এই ধারাকে আরো উৎসাহ দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে, যাতে চলচ্চিত্রচর্চার প্রসার ঘটে৷ উৎসাহ দেয়ার একটি অন্যতম উপায় হতে পারে চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখালেখিকে স্বীকৃতি দেয়া৷ ভারতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে একটি বিভাগ আছে— ‘চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখালেখি' নামে৷ এই বিভাগে দুটি পুরস্কার দেয়া হয়, একটি হলো শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের বই, অন্যটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র সমালোচক পুরস্কার৷ এই উদাহরণটি বাংলাদেশেও গৃহীত হতে পারে৷ কারণ, চলচ্চিত্র নির্মাণের চেয়ে চলচ্চিত্র বিষয়ে লেখালেখি কিন্তু মোটেও ছোট কোনো বিষয় নয়৷ বরং লেখা তৈরি করা, চলচ্চিত্র নির্মাণের মতোই কঠিন কাজ—এই সত্যটি কবুল করেছেন ফরাসি নির্মাতা গদার৷
শেষ কথা এটাই বলবো, স্রেফ মুনাফা আর সুনাম কামাইয়ের লোভে কেউ যেন চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকে পা না বাড়ান৷ মাথায় রাখতে হবে, চলচ্চিত্র শিল্পও বটে, এই শক্তিশালী ‘অস্ত্র'কে কিভাবে, কোন উপায়ে কাজে লাগাবেন সেটা জানা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি এই বিষয়ের উপর পাঠাভ্যাস৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷