‘টার্গেট আলেম তৈরি, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার নয়’
২৪ এপ্রিল ২০১৭এই সময়ে আলোচনার তুঙ্গে রয়েছে কওমি মাদ্রাসা৷ কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থাকে সরকার স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি দাওরায়ে হাদিসকে সাধারণ শিক্ষার মাস্টার্স-এর সমমান ঘোষণা করা হয়েছে৷ যদিও অন্যান্য স্তরের মান কী হবে, তা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি৷ এছাড়া আর দাওরায়ে হাদিস-এর মান নির্ধারণ নিয়েও জটিলতা আছে৷ কারণ কওমি শিক্ষার মধ্যে নানা ভাগ থাকায়, কেউ ন'বছর পড়াশুনার পর আবার কেউ ১২ বছর পড়াশুনার পর দাওরায়ে হাদিস পাশ করেন৷
১৮৬৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এই উপমহাদেশে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার শুরু৷
এই শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত আলীয়া মাদ্রাসাকে চ্যালেঞ্জ করে গড়ে ওঠে, তাও আবার কোনো প্রকার সরকারি সহযোগিতা ছাড়াই৷ আর এখন তারা সরকারের স্বীকৃতি নিলেও, কোনো ধরনের আর্থিক সহযোগিতা নিতে রাজি নয়৷
কওমি মাদ্রাসাকে সরকারের মনিটরিং বা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা ছিল অনেক আগে থেকেই৷ এ ধরনের মাদ্রাসার শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে ২০১৩ সালের ১৫ এপ্রিল কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়৷ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি ও চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক মাওলানা শাহ আহমদ শফীকে চেয়ারম্যান করে ১৭ সদস্যের কমিশন গঠন করা হয়৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ঐ বছরের ২৮ আগস্ট ‘কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৩' মন্ত্রিসভায় উঠানো হয়৷ যদিও মন্ত্রিসভা সেই আইনের খসড়া প্রত্যাহার করা৷ শেষ পর্যন্ত ১১ এপ্রিল শাহ আহমদ শফীর শর্ত মেনে নিয়ে তাঁর উপস্থিতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেন৷ কিন্তু কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারে যে কমিশন হয়েছে, আহমদ শফীর নেতৃত্বে তাতে সরকারের কোনো প্রতিনিধি নেই৷
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় বর্তমানে প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে৷ কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা আরো বেশি৷ তাছাড়া মাওলানা শাহ আহম শফীর নেতৃত্বে কওমি শিক্ষাবোর্ড সর্ববৃহৎ হলেও, এর বাইরে আরো পাঁচটি কওমি শিক্ষাবোর্ড আছে, যারা স্বাধীনভাবে মাদ্রাসা এবং কওমি শিক্ষা পরিচালনা করেন৷
কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত কোরান হাদিস ভিত্তিক৷ ভাষা হিসেবে আরবি, ফার্সি এবং উর্দুকে প্রাধান্য দেওয়া হয়৷ তবে আজকাল প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, ইতিহাস, গণিত এবং ভূগোল পড়ানো হয়৷ এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে কওমি শিক্ষাবিদরা বিশেষায়িত শিক্ষা হিসেবে দেখেন৷ কোরান হাদিস এবং ফিকাহ বিষয়ে দক্ষতা অর্জনই এর মূল লক্ষ্য৷ আরবি এবং উর্দু সাহিত্যও পড়ানো হয়৷
বাংলাদেশের প্রধানত মসজিদকে কেন্দ্র করেই কওমি মাদ্রাসাগুলো গড়ে উঠেছে৷ এই মাদ্রাসার ছাত্ররা প্রধানত আবাসিক৷ লিল্লাহ বোডিং-এর আওতায় তাদের থাকা, খাওয়া এবং পড়াশুনার খরচ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষই বহন করে৷ তবে তারা সরকারি কোনো সহযোগিতা বা অনুদান নেয় না৷ মুসলামানদের জাকাত, ফিতরা, কোরাবানির চামড়া, অনুদানের টাকায়ই মাদ্রাসাগুলো পরিচালিত হয়৷
এই শিক্ষা ব্যবস্থার যে কোনো পর্যায় থেকে সাধারণ শিক্ষার সমমানে প্রবেশের সুযোগ নেই৷ তাছাড়া বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগ বলতে কিছু নেই৷ সর্বোচ্চ দাওরায়ে হাদিস শ্রেণিতে হাদিসের ওপর ১০টি বিষয় পড়ানো হয় আরবিতে৷ আর একেই মাস্টার্সের সমমান ঘোষণা করা হয়েছে৷
আগামী ১৫ মে সরকারি স্বীকৃতির পর প্রথম দাওরায়ে হাদিসের প্রথম পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে৷ দাওরায়ে হাদিসের সনদের মান বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য মাওলানা মাহফুজুল হক ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘ছয়টি কওমি শিক্ষা বোর্ডকে এক করে এই পরীক্ষা হবে৷ এ জন্য একটি কমিটি হয়েছে৷ ঐ কমিটি সার্টিফিকেট দেবে৷''
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে অন্যান্য স্তরের সঙ্গে মান সমন্বয়ের কোনো প্রয়োজন নাই৷ সেটা করা হলে মাঝখান থেকে ছাত্ররা চলে যাবে৷ দেশে কোরান-হাদিসে শিক্ষিত দক্ষ আলেমের অভাব আছে৷ আমাদের টার্গেট দক্ষ আলেম তৈরি করা৷ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করা আমাদের কাজ নয়৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘সরকারি অর্থ সহায়তা নিলে সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে৷ তাতে দ্বীনি বা ইসলামের শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ তাই আমরা সরকারে অনুদান নেব না৷''
ঢাকার জামিয়া ইসলামিয়া ওয়াহিদিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন বলেন, ‘‘আমাদের টার্গেট কোরান-হাদিসে শিক্ষিত আলেম গড়ে তোলা৷ এটা একটি বিশেষায়িত শিক্ষা৷ প্রথম থেকেই তাই কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের ওই বিষয়গুলোই পড়ানো হয়৷ যাদের আগ্রহ আছে তারা পড়বেন৷ অন্য বিষয়ে পড়শুনা করার জন্য তো আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘তবে এখন প্রথমদিকে বাংলা, ইতিহাস, ভুগোলের মতো কিছু বিষয় পড়ানো হয়৷''
এই উপমহাদেশে ১৭৮০ সালে ১ অক্টোবর সনে ব্রিটিশ সরকার কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে৷ তারাই আলীয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তক৷
আলিয়া মাদ্রাসায় কোরান, হাদিস, আরবি ভাষা ও সাহিত্যসহ ইসলামের মৌলিক বিষয়ের পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি, পৌরনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, কৃষি, কম্পিউটার, কারিগরি প্রভৃতি বিষয় শেখানো হয় বাধ্যতামূলভাবে৷ এই শিক্ষা ব্যবস্থায় আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে ধারাবাহিভাবে৷ যদিও শুরুতে তা ছিল না৷
বাংলাদেশে বর্তমানে ইবতেদায়ী মাদ্রাসার সংখ্যা ৬,৮৮২টি, দাখিল মাদ্রাসা ৯,২২১টি, আলিম মাদ্রাসা ২,৬৮৮টি৷ ফাযিল মাদ্রাসা ১,৩০০টি ও কামিল মাদ্রাসা ১৯৪টি৷ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করেই আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে৷ সরকারি মাদ্রাসা যেমন আছে তেমনি এমপিওভুক্ত মাদ্রাসাও আছে৷ আলিয়া মাদ্রাসার প্রতিটি ক্লাসই সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে মান ঠিক করা আছে৷ ১৯৮৫ সালে দাখিল এসএসসি সমমানের সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে৷ ১৯৮৭ সালে আলিম এইচএসসি সমমান৷ আর ২০০৬ সালে ফাযিলকে স্নাতক এবং কামিল স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্সের সমান মানের ডিগ্রির মর্যাদা দেয়া হয়৷ ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষ মাদ্রাসায় ফাযিল স্নাতক অনার্স কোর্স চালু হয়৷
আলিয়া মাদ্রাসা থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে সাধারণ শিক্ষায় প্রবেশের সুযোগ আছে৷ বিশেষ করে আলিম বা এইচএসসি পাশের পর ছাত্ররা চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ভর্তি হতে পারেন৷ সরকারের মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে আলিয় মাদ্রাসাগুলো পরিচালিত হয়৷ এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে৷
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক এবং আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার গবেষক ড. সৈয়দ শাহ এমরান নিজেও আলিয়া মাদ্রাসায়া পড়াশুনা করেছেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বর্তমানে আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় করা হয়েছে৷ সরকারি এই শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামি শিক্ষার সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার সিলেবাসের বিজ্ঞান এবং মানবিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷ আর আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের যে কোনো পর্যায়ে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ আছে৷ এখান থেকে পাশ করে চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ ও সামাজিক বিজ্ঞানসহ সব ধরনের বিষয় পড়ার সুযোগ আছে৷ কিন্তু এখানো কমার্স বা বাণিজ্য শিক্ষা চালু হয়নি৷ তবে সেটারও চেষ্টা চলছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ এটি সম্পূর্ণভাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত একটি শিক্ষা ব্যবস্থা৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এর কোর্স এবং কারিকুলাম নির্ধারণ করে৷ সাধারণ শিক্ষায় বিভিন্ন ক্লাসে যে বই পড়ানো হয়, এখানেও তাই৷ আমি বলতে পারি যে, আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা ইসলমী শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষায়ও শিক্ষিত হয়৷ এছাড়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আছে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থাও৷''
শিক্ষাবিদ এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ২০১০ সালের শিক্ষা নীতির আলোকেই চলছে৷ এই শিক্ষা ববস্থা সরকারি এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণেই আছে৷ তাই আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে মিলিয়েই এর কোর্স বা কারিকুলাম তৈরি হয়েছে৷ কিন্তু কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই৷ এর কারিকুলাম তৈরিতে সরকার বা রাষ্ট্রের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই৷ এটা কীভাবে সম্ভব?''
তাঁর কথায়, ‘‘সরকার হঠাৎ করেই কওমি মাদ্রাসার একটি কোর্সকে মাস্টার্সের সমমান ঘোষণা করল৷ এটা করার আগে কোনো গবেষণা হয়েছে? কোনো তথ্য নেওয়া হয়েছে যে ঐ কোর্সটি মাস্টার্সের সমমানের কিনা? দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান করা হলে আগের ধাপগুলোর মর্যাদা কী?''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে বা মনিটরিং-এর বাইরে একটি শিক্ষা ব্যবস্থা চলতে পারে না৷ তাদের অর্থের উৎস কী? তারা কী পড়ায়? পড়ানোর মান কেমন? এ সব সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকতে পারে না৷ ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে শিক্ষায় বৈষম্য কমানোর কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু করা হচ্ছে ঠিক উল্টো৷''
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷