‘আমাদের ভাষার প্রতি, দেশের প্রতি প্রেম একটু কম’
৫ মার্চ ২০২১ডয়চে ভেলে: এখন ‘জান ও জবানের স্বাধীনতা’ শব্দ গুচ্ছ নিয়ে নানা কথা হচ্ছে৷ বাংলা ভাষায় অন্য ভাষা বা বাইরের শব্দ প্রবেশে রাজনীতি, ধর্ম বা সাম্প্রদায়িকতা যা-ই বলুননা কেন কতটা প্রভাব রাখছে?
ফরিদ কবির: দেশের মানুষের মধ্যে দুই শ্রেণির মানুষ আছে৷ সেটা ভারত ভাগের পর থেকেই আছে৷ একটা সাম্প্রদায়িক শক্তি, সব সময়ই তারা সক্রিয় ছিল৷ আবার একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিষয়টিও সক্রিয় ছিল৷ যে কারণে আমরা দেখি ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান হওয়া৷ পাকিস্তানে উর্দু রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দেয়া৷ তারপরে এই দেশের মানুষের মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সব কিছু মিলিয়ে ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীন দেশের প্রতি যাত্রা৷ এই পুরো ইতিহাস যদি আমরা দেখি তাহলে আমরা দেখবো এখানে সাম্প্রদায়িক শক্তি সক্রিয় ছিল এবং অসাম্প্রাদায়িক শক্তিও বড় রকমের সক্রিয় ছিল৷ সাম্প্রদয়িক শক্তির দৈনন্দিন জীবনের যে চর্চা, ভাষায় তো তার প্রভাব পড়বেই৷ বাঙালি মুসলমানদের যারা আরবি-ফার্সির চর্চা একটু বেশি করেন, তাদের মাধ্যমে আমাদের ভাষায় আরবি-ফারসি ঢুকেছে৷ আবার ইংরেজি ও হিন্দি শব্দের ব্যবহারও আমরা লক্ষ্য করি৷ ভাষা একটি বহতা নদীর মতো ৷ তাই আপনি চাইলেই ভিনদেশি শব্দ বের করে দিতে পারবেন না৷ এরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঢুকে পড়ে৷ এটাই ভাষার সৌন্দর্য৷
চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা আছে ?ইনশাল্লাহ, মাশাল্লাহ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কথা আছে৷ আবার হিন্দির প্রবেশ নিয়েও কথা হয়৷ এখানে অনকাঙ্খিত কোনো প্রবণতা আছে বলে মনে করেন?
আমার ব্যক্তিগতভআবে মনে হয় না যে, চাপিয়ে দেয়া কোনো কিছু কোনো ভাষা কখনো গ্রহণ করে৷ আমি হিন্দুদেরও মাশাল্লাহ বলতে শুনেছি৷ কোলকাতায় বলে মাশাল্লাহ খুব ভালো৷ তখন এটার ভিতরে কিন্তু আর ধর্মীয় বিষয় থাকে না৷ হিন্দি সিনেমায়ও হিন্দু ক্যারেক্টার মাশাল্লাহ বলে৷ আবার মুসলমানরাও আদাব বলে৷ এটা আত্মীকরণ৷ চাপিয়ে দেয়া হলে ভাষা তা নেয় না৷
বাংলা বলতে গিয়ে অনেক ইংরেজি শব্দের মিশ্রণ বাংলা ভাষার কোনো ক্ষতি করে কিনা...
এটা হীনমন্যতা থেকে হয়৷ অনেকে মনে করেন, বাংলার সাথে ইংরেজি মেশালে হয়তো একটু স্মার্ট লাগবে, একটু শিক্ষিত মনে হবে৷ একটা ঔপনিবেশিক মানসিকতা তো আমাদের মধ্যে আছে৷ যেকোনো ভাষা দাঁড়ায় তার অর্থনৈতিক শক্তির ওপর৷ ভাষার রাজনৈতিক দিক যেমন থাকে৷ তার একটি অর্থনৈতিক দিক আছে৷ জাপানিদের অর্থনীতি শক্তিশালী৷ তাদের ইংরেজি বা অন্য ভাষা না শিখলেও চলে৷ আবার কেউ কেউ নিজের ভাষাকে মর্যাদা দিতে জানে৷ যেমন তামিলরা৷ ভারতে হিন্দি যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তারা কিন্তু তামিল ভাষার বাইরে বলবে না৷ আমাদের বাঙালিদের মধ্যে আমার মনে হয়, যে কারণেই হোক, ভাষার প্রতি যে প্রেম, দেশের প্রতি যে প্রেম, সেটা কিছুটা কম আছে৷
বিদেশি শব্দ আমরা বাংলায় কিভাবে নেবো, কতটা নেবো এর কি কোনো নিয়ম আছে? বাংলা একাডেমির অভিধানের কি কোনো নিয়ম আছে এ ব্যাপারে?
বাংলা ভাষার অভিধান তো বাংলা ভাষারই অভিধান৷ তবে বিদেশি ভাষা কতটা, কীভাবে নেয়া হবে, তার কোনো নিয়ম আছে কিনা তা আমি বলতে পারবো না৷ এটা ভাষা বিজ্ঞানীরাই ভালো বলতে পারবেন৷ তবে বাংলা ভাষা, ভাষা হিসেবে স্বয়ংসম্পূর্ণ৷ হাজার বছরের বাংলা ভাষা নানা চড়াই-উৎড়াই পাড়ি দিয়ে, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এই পর্যায়ে এসেছে৷ ভাষা নিজেই বদলায় নিজেকে৷
এক সময় উর্দু হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা হয়েছে৷ এখন রোমান হরফের বাংলা লেখা হচ্ছে৷ বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে লেখার প্রবণতা...
বাংলা ভাষার প্রতি প্রেম না থাকলে এরকম হয়৷ এখন ইউনিকোডে এত রকম ব্যবস্থা আছে যে, আপনি চাইলে বাংলাই লিখতে পারেন৷
আঞ্চলিক ভাষা কি মান বাংলা ভাষার পথে কোনো বাধা?
আমি মনে করি, আমাদের প্রতিটি আঞ্চলিক ভাষাই আলাদা বৈশিষ্ট্যের এবং আলাদা মর্যাদার৷ তবে যখন আমরা সবার জন্য বলবো তখন একটা মান ভাষা থাকবে৷
ভাষায় বর্ণবাদ, লিঙ্গ বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা এগুলো কি ভাষার সমস্যা?
না, এগুলো মানুষের সমস্যা৷ ব্যবহারের সমস্যা৷ কয়েক দিন ধরে ফেসবুক গরম হয়ে উঠেছে প্রথম আলোর একটি শিরোনা নিয়ে- ‘কালো, তবু সুন্দর’৷ এটা তো ব্যবহারের সমস্যা৷ কারণ, এটা যিনি ব্যবহার করলেন তার মধ্যে বর্ণবাদ বিষয়টি রয়ে গেছে৷ বিশেষ বর্ণের প্রতি তার ভালোবাসা, তার প্রেম, এটা বোঝা যায়৷ আবার এটা থেকে বিশেষ বর্ণের প্রতি তার অনাগ্রহ, অপ্রেম-এটাও বোঝা যায়৷
বাংলা ভাষা কি এখন আধিপত্যবাদী? এখানে তো অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা আছে৷ তাদের ওপর কি বাংলা আধিপত্য বিস্তার করছে?
এটা আমি ভাষার সমস্যা মনে করি না৷ এই সমস্যা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির৷ কারণ, ভাষারও তো একটা রাজনীতি আছে৷ যেমন, এব সময় উর্দু আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে৷ আমরাও চাইছি এখন বাংলা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ সবার ওপর চাপিয়ে দিতে৷ যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা চায় তাদের ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে৷ এটা করা হয় আধিপত্যবাদী মানসিকতা থেকেই৷ কিন্তু এটা হওয়া উচিত না৷ প্রতিটি ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে৷ আমাদের ভাষা আন্দোলন তো মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন৷ তাই সব মাতৃভাষার প্রতিই আমাদের দরদ দেখতে হবে৷ তাদের সক্রিয় রাখা আমাদের দায়িত্ব৷