‘আমার পুতের তো গুলি খাইয়া মরার কথা না'
২ সেপ্টেম্বর ২০২২তার ছোট ছেলে ২০ বছর বয়সি শাওন প্রধান বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নারায়ণগঞ্জ শহরের ডিআইটিতে বিএনপি ও পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন৷ ছেলের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে পাগলপ্রায় মা পঞ্চাশোর্ধ্ব ফরিদা বেগম৷
ছেলের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর বাড়ির সামনে উঠানে পা ছড়িয়ে আহাজারি করছিলেন৷ পাগলপ্রায় মা পঞ্চাশোর্ধ্ব ফরিদা বেগম বলছিলেন, ‘‘ আমার পুতে জানি কয়বার মা কইয়া ডাকছে৷ আমার পুতে জানি কেমন করতেছে৷ তোমরা কেউ আমারে নিতেছ না ক্যান?’’
নারায়ণগঞ্জের পূর্ব গোপালনগরের বাড়ির অদূরে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা তৈরির কারখানায় কাজ করতেন শাওন৷ নিহত শাওন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার এনায়েতনগর ও বক্তাবলী ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী পূর্ব গোপালনগর এলাকার মৃত সাহেব আলীর ছেলে৷ নবীনগর শাহ্ওয়ার আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে শাওনদের একতলা বাড়ি৷
ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে বোন ছুটে আসেন; মায়ের কোলে আছড়ে পড়েন তিনিও৷
ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে স্থানীয়রা জানান, চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে শাওন সবার ছোট ৷ বছর দুয়েক আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বড় মেয়ে হেনা ৷ তার এক মাস পর মানসিক ভারসাম্যহীন বড় ছেলে লিটন গলায় ফাঁস লাগিয়ে মারা যান ৷ পরপর দুই সন্তানের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠলেও ছোট ছেলের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না ফরিদা বেগম ৷
তাকে বারবার সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন পাশে বসে থাকা বোন জমিলা বেগম ৷ প্রতিবেশীরাও নানাভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তাকে কিন্তু কিছুতেই মানছেন তা ফরিদা ৷
চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘‘ আল্লায় নিলে নাইলে মানা যাইতো৷ আল্লায় তো নিলো না৷ আমার পুতের তো গুলি খাইয়া মরার কথা না৷’’
এ সময় শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ঢোকেন ফরিদার আরেক মেয়ে শিল্পী ৷ ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে কেরানীগঞ্জের জাজিরা থেকে ছুটে এসেছেন তিনি৷ মা-কে উঠানে কাঁদতে দেখে একছুটে তার বুকে লুটিয়ে পড়েন শিল্পী৷ মা-ও মেয়ের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে আশেপাশের বাতাস৷
পরিবারের সদস্যরা জানান, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা শাওনের৷ বাড়ির অদূরে একটি ইজিবাইক তৈরির কারখানায় গত তিনমাস যাবত কাজ করতেন শাওন৷
শাওন প্রতিদিন সকাল ৯টায় কারখানায় গেলেও বৃহস্পতিবার সকালে যাননি বলে জানান একই কারখানার শাওনের সহকর্মী মো. হাবিবউল্লাহ৷
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘ ওয়েল্ডিং শ্রমিক হিসেবে কাজ করত শাওন৷ প্রতিদিন সকাল ৯টার দিকে কাজে আসার কথা৷ আজকে আসে নাই৷ শুনছি শহরে বিএনপির মিছিলে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে সে৷’’
প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর বিএনপির নেতা-কর্মীরা সকাল ১০টায় নগরীর ডিআইটিতে আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তনের সামনে থেকে শোভাযাত্রা বের করার প্রস্তুতি নেয়৷ এতে পুলিশ বাধা দিলে নেতা-কর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়৷ বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত দফায় দফায় চলে এই সংঘর্ষ৷ এই সময় গুলিবিদ্ধ হন শাওন৷
গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শাওনকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন কয়েকজন৷ তাদের মধ্যে একজন নিজেকে দেওভোগের বাবুরাইল এলাকার বাসিন্দা ও বিএনপির কর্মী বলে পরিচয় দেন৷তিনি নিজেও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন জানিয়ে ডান পায়ে গুলির আঘাত দেখান৷
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২৮ বছর বয়সওই ব্যক্তি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘ওর (শাওন) লগে আরও লোক আছিল৷ আমরাও ছিলাম৷ তয় ওরে আমরা চিনতাম না৷ ওয় অন্য গ্রুপের লগে আইছে৷ পুলিশ যখন গুলি করতেছিল তখন আমরা গুলশান হলের গেটের সামনে ছিলাম৷ দুই পাশ দিয়াই ইট-পাটকেল মারতাছিল অনেকে৷ ওই পোলায় একটা ইট হাতে নিয়া রাস্তায় নামার পরই একটা গুলি আইসা তার বুকে লাগে৷ নিচে পইড়া গেলে তারে তুইলা গুলশান হলের গেটের সামনে আইনা রাখি৷ পরে ওয় কয়, ‘ভাই আমারে হাসপাতালে নিয়া যান, আমার ভাল্লাগতাছে না'৷ হাসপাতালে আসার পর ডাক্তার কইছে ওয় মারা গেছে৷’’
এদিকে শাওনের মৃত্যুর পরপর ফেসবুকে বিএনপির একটি মিছিলের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে৷ ওই মিছিলের অগ্রভাগে ডোরাকাটা টি-শার্ট ও কালো রঙের জিন্স প্যান্ট পরা অবস্থায় শাওনকে দেখা যায়৷ হাসপাতালে শাওনের মরদেহেও একই টি-শার্ট ও জিন্স প্যান্ট রয়েছে৷
যদিও শাওন রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নয় বলে দাবি করেছে তার পরিবারের লোকজন৷
শাওনের বড়ভাই ফরহাদ প্রধান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘ আমার ভাই কোনো রাজনীতির সাথে যুক্ত না৷ স্থানীয় যুবদলের কয়েকজন নেতার ডাকে শাওন মিছিলে যায়৷ দুপুর ১২টার দিকে জানতে পারি গুলিবিদ্ধ হইয়া শাওন হাসপাতালে৷’’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিহত শাওন ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বক্তাবলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শওকত আলীর ভাতিজা৷
শওকত আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘ শাওনের বাবা সাহেব আলী আমার আপন চাচাত ভাই ছিল৷ সেই হিসেবে শাওন আমার ভাতিজা৷ শাওনের বড়ভাই মিলন আমার সাথেই থাকে৷ আমি নিজে আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি৷ তবে ওরা ভাইরা সরাসরি কোনো দল করে না৷ ডাক দিলে আমার লগেও যায়, আবার অন্য কেউ ডাক দিলেও যায়৷ এলাকার কারও ডাকে শহরে বিএনপির মিছিলে গেল কিনা সেই বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত না৷’’
এনএস/এসিবি (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)