শিশুশ্রম বন্ধে করণীয়
৭ অক্টোবর ২০১৫গরিব ঘরের মেয়ে৷ কিন্তু রং ছিল আশ্চর্যরকম ফরসা, তার সঙ্গে কোঁকড়া, কালো কুচকুচে চুল, গোলগাল মুখের গড়ন৷ ঠিক যেন দুগ্গা প্রতিমা৷ তাই তো নানি আদর করে ওর নাম রেখেছিলেন – দেবী৷ সিলেটে আমাদের দেশের বাড়িতে ওর বাবা চাষ-বাসের কাজ করতো৷ অভাবের সংসার বলে নানি-ই ওকে নিয়ে এসেছিলেন ঢাকায়৷ আমার তখন সাত বছর বয়স৷ তার মানে ওর ১২ হবে৷ নানিকে ‘মা' ডাকতো, তাই আমি বলতাম – দেবী মাসি৷
বাড়িতে রান্না, ঘর ঝাড় দেয়া-মোছা, বাসন মাজা – সব কিছুর জন্যই লোক ছিল৷ কিন্তু এরপরও সমস্ত ফাই-ফরমাস কাজে ডাকা হতো দেবী মাসিকে৷ গাছে জল দেয়া, ফুল তোলা, কবুতরকে খাওয়ানো, আটা মাখা, পূজার কাজে নানিকে সাহায্য করা, নানার পা টেপা, ঘর গোছানো, ছাদ থেকে জামা-কাপড় তোলা, তারপর সেগুলো ইস্ত্রি করা, অ্যাকিউরিয়াম পরিষ্কার করা, মাছগুলোকে খাবার দেয়া – এমন কোনো কাজ ছিল না, যা ওকে করতে হতো না৷ সারা দিনে কতজন যে ওকে কতবার ডাকতো, তার কোনো হিসেব নেই৷ তার ওপর আবার রান্নার সখ ছিল দেবী মাসির৷ নানির কাছে থেকে বছরের পর বছর সব শিখে নিয়েছিল সে৷ পোলাও-বিরিয়ানি তো বটেই, পেস্ট্রি, প্যাটিস, সামোসা তৈরিতেও তার জুড়ি মেলা ছিল ভার৷ কিন্তু এত সব শিখলেও, পড়াশোনাটা আর হয়নি দেবী মাসির৷ আমার থেকে মাত্র ৫ বছরের বড়৷ তাই আমি যখন পড়তে বসতাম, সুযোগ পেলেই ছুটি চলে আসতো৷ আমার বইগুলো, অঙ্কের খাতাগুলো ওপর হুমড়ি খেয়ে বসতো৷ প্রথম প্রথম বাংলা বইগুলো, ছোট-খাট যোগ-বিয়োগ করতেও দেখেছি তাকে৷ কিন্তু ধীরে ধীরে আমি যখন উঁচু ক্লাসে উঠতে লাগলাম, পিছিয়ে পড়লো দেবী মাসি৷ তারপর একটা সময় বন্ধই করে দিল পড়ার ঘরে আসা৷ আমার খারাপ লাগতো, রাগ হতো নানির ওপর৷ কেন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিচ্ছে না মাসিকে?
দেবী মাসিকে নানি একজন দর্জির সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন৷ জমি-জমা দিয়েছিলেন, এমনকি টেইলারিং-এর একটা কোর্স-ও করিয়েছিলেন৷ কিন্তু পড়াশোনা না করতে পারার দুঃখ দেবী মাসির কোনোদিন যায়নি৷ তবে হ্যাঁ, এটা ঠিক যে দেবী মসি যদি সিলেটের সেই গণ্ডগ্রামেই থেকে যেত, তাহলে হয়ত ঢাকা শহরের মাঝে আজকের এই ‘রাজধানী টেইলার্স' আর তার দেওয়া হতো না৷ হতো না নিজের মেয়েকে কলেজে পড়ানো অথবা থাকতো না ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করার স্বপ্ন৷
তাহলে? নানি কি ছোট্ট দেবীকে গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে এসে ঠিক করেছিলেন? আজও ভারত-বাংলাদেশের অজস্র পরিবারগুলো বাচ্চা বাচ্চা ‘কাজের লোক' রেখে কি ঠিক করছে? যে শিশুর শৈশবকে হত্যা করা হচ্ছে তাকে স্থানান্তরিত করে, ছুটে-বেড়ানোর বয়সে তাকে ভারি কাজ করতে বাধ্য করে, ছোট্ট কাঁধে বাপ-মা-ভাই-বোনকে দেখার দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে, তার ভবিষ্যৎ কি অভাব-অনটনের সংসারে থাকা বা বন্যার জলে ভেলে যাওয়া কোনো শিশুর ভবিষ্যৎ থেকে উজ্জ্বল নয়?
এ সব প্রশ্নের উত্তর বিচার করবেন আপনারা৷ আমি শুধু বলতে পারি, শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে প্রথমে সব শিশুকে সম অধিকার দিতে হবে, পারিবারিক দরিদ্রদশা দূর করতে হবে, বৃদ্ধি করতে হবে সামাজিক সচেতনতা৷ আর তার জন্য জন্ম নিবন্ধন নিশ্চিত করে প্রতিটি শিশুকে শুধু বাধ্যতামূলক শিক্ষাই নয়, দু'বেলা পেট ভরা খেতে দিতে হবে৷
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিরসনে আইএলও কনভেনশন ১৩৮ অনুস্বাক্ষর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ কিন্তু সমস্যা হলো এর বাস্তবায়ন৷ জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, একটি শিশুকেও তার জীবিকা নির্বাহের জন্য কোনোরকম শ্রমে নিয়োজিত করার কথা নয়৷ কিন্তু এ দেশের শিশুরা মূলত দরিদ্রদশার কারণে শ্রমের সাথে জড়িত৷ তার ওপর বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন ও নীতিমালায় বয়সের বিভিন্নতার কারণে শিশুদের শ্রম থেকে দূরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না৷ শুধু তাই নয়৷ সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের চূড়ান্ত তালিকা ও শিশু আইন ২০১৩ অনুমোদন করেছে সরকার৷ কিন্তু নীতিমালায় গৃহিত হওয়া মানেই তো আর শিশুশ্রম নিরসন নয়! তাই সরকার এ বছরের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ খাতগুলো থেকে শিশুশ্রম শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও, এখনো সেই সব খাতে শিশুশ্রমিক আছে এবং সংখ্যাটা বেড়েছে বৈ তো কমেনি৷ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে আজও ৪৫ লাখেরও বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে৷
‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন' বেশ কয়েক বছর ধরে শিশুদের নিয়ে, বিশেষ করে শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করছে৷ সংগঠনটির প্রকল্প সমন্বয়ক আবদুল্লাহ আল-মামুন জানান, ‘‘প্রধানত অনানুষ্ঠানিক খাত, যেমন ওয়েল্ডিং, মোটর গ্যারেজ, মোল্ডিং, ইটের ভাটা ইত্যাদি কাজে শিশুশ্রমের সংখ্যা বাড়ছে৷'' সে তুলনায় বাড়িতে ফাই-ফরমাস খাটা তো দুধ-ভাত৷ তাই নয় কি? তাছাড়া বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অভিভাবক ও মালিক – দুই পক্ষই শিশুদের শ্রমে নিয়োজিত করে৷ আমার দেবী মাসির বাবাই তো তাকে নানির হাতে তুলে দিয়েছিলেন, যাতে ছয় বোনের মধ্যে সে একটু ভালো খায়, একটুখানি ভালো থাকে৷ তাই আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ছাড়া শিশুশ্রম নিরসন করা তো যাবেই না, আর করা গেলেও তাতে শিশুরা যে ভালো থাকবে, সুস্থ, সুন্দর থাকবে, তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে?
দেবারতি গুহ’র বক্তব্যের সঙ্গে আপনিও কি একমত? ভিন্নমত থাকলে লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷