আসামের নাগরিকপঞ্জি নিয়ে এবার সংসদে উত্তেজনা
৯ জানুয়ারি ২০১৮আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নবীকরণে বাদ পড়েছে রাজ্যের প্রায় এক কোটি চল্লিশ লাখ মানুষের নাম, যাঁদের বেশিরভাগই বাঙালি৷ স্বভাবতই এই ঘটনা পুরনো ইতিহাস মনে করিয়ে দিচ্ছে৷ অনেকেই বলছেন, এর সঙ্গে ‘বাঙালি খেদাও' অভিযানের মিল আছে৷ ভারতের সংসদেও এই নিয়ে শুরু হয়েছে বিতণ্ডা৷ সংসদের ভেতরে ও বাইরে তৃণমূলসহ অন্যান্য বিরোধী দলের প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলছে৷
আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) নবীকরণে যাঁদের নাম বাদ পড়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই বাঙালি কেন ? সংসদে এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস, সিপিএমসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলি৷ অভিযোগের আঙুল তুলেছেন তৃণমূলনেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ এক জনসভায় তাঁর মন্তব্য, ‘‘এর পেছনে কি বিজেপিশাসিত আসাম থেকে বাঙালি খেদাও ষড়যন্ত্র আছে?'' তাঁর হুঁশিয়ারি, বাঙালিদের গায়ে হাত পড়লে কাউকে ছেড়ে কথা বলা হবে না৷ এত বাঙালি যাবেন কোথায়? স্লোগান উঠেছে, ‘‘বাংলা ভাষাভাষিদের আটক শিবির বন্ধ করো৷'' পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এই অভিযোগ সরাসরি নস্যাৎ করে বলেন, ‘‘বাঙালিদের আশঙ্কার কোনো কারণ নেই৷ এই নাগরিকপঞ্জি চুড়ান্ত নয়৷ এটা খসড়ামাত্র৷ এরপর আরো খসড়া প্রকাশিত হবে৷ তারপরেও যদি কারোর নাম বাদ পড়ে বা আপত্তি থাকে, তাহলে তারা ট্রাইব্যুনালে যেতে পারেন৷ কাজেই চিন্তার কিছু নেই৷''
এই বিষয়ে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের সঙ্গেও পৃথক বৈঠকে মিলিত হন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ ধন্দ এখানেই৷ কেন তিনি তৃণমূল সাংসদের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করলেন ? কারণ, মমতার এই হুঁশিয়ারিতে আসামে বাঙালিদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে৷ অনেকের আশঙ্কা, এই প্রতিক্রিয়া দাঙ্গায় রূপ নিলে বিপদ বাড়বে৷ তা যাতে না হয়, তার জন্য সৌগত রায়ের মাধ্যমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বার্তা দিতে চেয়েছেন রাজনাথ৷
প্রশ্ন হলো, জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নবীকরণ নিয়ে এত তোলপাড় কেন? সমস্যাটা ঠিক কোথায়? যাঁদের নাম বাদ পড়েছে তাঁরা কি দেশের বৈধ নাগরিক নন? তাঁরা কি মূলত বাংলাদেশী? অবৈধ অনুপ্রবেশকারী? কীভাবে তা নিশ্চিত হওয়া যাবে?
এই প্রসঙ্গে এনআরসি কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হয়, আসাম রাজ্যের সরকারি নথিতে যাঁদের নাম আছে, তাঁদের পরিবারের বংশতালিকা খতিয়ে দেখা হয়েছে৷ ভারতীয় হওয়ার পাশাপাশি সাবেক রাজ্যে অর্থাৎ, যে রাজ্য থেকে তিনি বা তাঁর পরিবার আসামে এসেছেন সেই সাবেক রাজ্যের বিভিন্ন প্রমাণপত্র যেমন, জমিজমার দলিল, ভোটার কার্ড, আধারকার্ড ইত্যাদি জমা দিতে হবে৷ যাঁরা দিতে পারবেন না, তাঁরাই অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত হবেন৷ এর জন্য পশ্চিমবঙ্গসহ ২৮টি রাজ্যে এইসব নথিপত্র যাচাই করার জন্য পাঠানো হয়েছিল৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ-প্রশাসনের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি৷ পশ্চিমবঙ্গে পাঠানো হয়েছিল এক লক্ষ এগারো হাজার নথি৷ দু'বছর পরে যাচাই করে ফেরত পাঠানো হয় মাত্র হাজার পাঁচেক৷
১৯৫১ সালের পর এই প্রথম আসামে বৈধ নাগরিকত্ব নবায়ন হচ্ছে৷ প্রথম খসড়ায় তিন কোটি উনত্রিশ লক্ষের মধ্যে মাত্র এক কোটি নব্বই লাখের নাম উঠেছে৷ এই নিয়ে গণ্ডগোল এড়াতে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়৷ বিশেষ স্পর্শকাতর এলাকাগুলিতে সেনাবাহিনীকে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে৷
নাগরিক পঞ্জি নবায়ন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আসামের সাংসদ বদরুদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই প্রথম লিস্টটা বেরিয়েছে৷ এতে আমার পার্টির তিনজন সাংসদের নাম নেই৷ ছ'জন বিধায়কের নাম নেই৷ কংগ্রেসের তিন-চার জন বিধায়ক এবং বিজেপির তিন-চারজন বিধায়কের নাম নেই৷ পরের লিস্টে মনে হয় নাম উঠবে৷ ভিআইপি হলে আগে উঠতে লাগে৷ তাই আগে থেকে কিছু বলাটা ঠিক হবে না৷ আশা করি, ফাইনাল লিস্টে আমাদের নাম থাকবে৷ আমরা আশাবাদী৷ তবুও যদি না ওঠে, তাহলে অনেক পথ খোলা আছে৷ তখন সেগুলো কাজে লাগাবো৷''
আসাম সংখ্যালঘু সেলের জেনারেল সেক্রেটারি এবং রাজ্যের বিধায়ক আমিনুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বললেন, ‘‘এই মূহুর্তে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না৷ সবে এনআরসির প্রথম খসড়া বের হয়েছে৷ দু'টো পার্টে তা সম্পুর্ণ হবে৷ সুপ্রিম কোর্টের তদারকিতেই কাজটা হচ্ছে৷ শুধু বাঙালিদের নয়, অনেক অসমীয়াদেরও নাম ওঠেনি৷ বিভিন্ন এলাকার পরিবারদের কিছু সদস্যের নাম উঠেছে, কিছু বাদ গিয়েছে৷ অন্য রাজ্য থেকে আসা ব্যক্তিদের নামধামের সত্যতা যাচাই করতে নথি পাঠানো হয়েছে৷ যে রাজ্য থেকে তাঁরা এসেছেন, সেইসব রাজ্যে৷ কাজটা সম্পূর্ণ হওয়ার পরই এর দোষগুণ বিচার করা সম্ভব৷ তবে যে লিস্ট প্রকাশিত হয়েছে, তারমধ্যে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম বাদ পড়ায় আমরা শীর্ষ আদালতের রাজ্য কো-অর্ডিনেটরের সঙ্গে সে বিষয়ে বৈঠক করেছি৷''
উল্লেখ্য, ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি ভারতে পালিয়ে আসেন৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁদের সবাই ফিরে যাননি৷ অনেকেই এদেশে থেকে যান৷ তাঁদের ফেরত পাঠানো হয়নি৷ এই নিয়ে রাজ্যে শুরু হয় আন্দোলন৷ শেষে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার এবং আসাম ছাত্র ইউনিয়ন ও আসাম গণ সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে ১৯৮৫ সালে স্বাক্ষরিত হয় শান্তি চুক্তি৷ সেখানে ভারতীয় নাগরিক এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করার সংস্থান রাখা হয়েছিল৷ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এবং হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ ইস্যুকে নির্বাচনী হাতিয়ার করেছিল৷ ২০১৪ সালের সংসদীয় নির্বাচনের প্রচারে নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর জিগির তোলেন৷ হিন্দু শরণার্থী এবং মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের আলাদা আলাদাভাবে চিহ্নিত করেন৷ ২০১৯ সালের সংসদীয় নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে বিজেপি সেই একই অস্ত্র প্রয়োগ করছে বলে মনে করছে পর্যবেক্ষক মহল৷