আহারে যখন অনীহা হয়
১৪ এপ্রিল ২০১৩বুলিমিয়া ও অ্যানোরেক্সিয়া রোগীদের জন্য জার্মানির বন শহরে একটি চিকিত্সা কেন্দ্র রয়েছে৷ সেখানে থেরাপি নিচ্ছেন ৩১ বছর বয়সি হানা৷ কিন্তু খুব সন্তর্পণে এই কেন্দ্রে যাতায়াত করতে হয় তাঁকে৷ কেউ যদি দেখে ফেলে! ১৬ বছর ধরে বুলিমিয়াতে ভুগছেন হানা৷ খাওয়ার পর বমি করে ফেলেন তিনি৷ বয়ঃসন্ধিকাল থেকে শুরু হয় এই উপসর্গ৷ ঐ সময় থেকে ওজন বাড়তে থাকে তাঁর৷ তাই নানা রকম ডায়েট শুরু করেন৷ ওজন কিছুটা কমলেও পরে আবার বেড়ে যায়৷ এটা মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি তরুণী হানার পক্ষে৷ তাই হজম হওয়ার আগেই গলায় আঙুল ঢুকিয়ে খাবার বের করা ফেলা শুরু করেন৷
নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়
প্রথম প্রথম হানার মনে হয়েছিল, যে কোনো সময় বুঝি এই অভ্যাসটা বন্ধ করা যাবে৷ কিন্তু সে গুড়ে বালি৷ নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন তিনি৷
এরপর থেকে খাবারকে দুইভাগে ভাগ করেন এই ভুক্তভোগী৷ ভাল খাবার, খারাপ খাবার৷ কিন্তু ক্যালোরি সমৃদ্ধ খাবার দেখলে পাশ কাটাতে পারেন না৷ হঠাৎ করে প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়ে বসে৷ সাধারণত মন খারাপ হলে বা রাগ হলে এই রকমটি হয়৷ বিশেষ করে চকোলেটের লোভ সামলানোটা হয় কঠিন৷ একটার পর একটা মুখে পুরতে ইচ্ছা হয়৷ তারপর জাগে বিবেকের দংশন৷ ওজন বাড়াটা কোনোমতেই সহ্য হয় না৷ ছুটতে হয় বাথরুমে৷ খাদ্যদ্রব্য উদগিরণ করে হয় একটু স্বস্তি৷ এছাড়া চলে বারবার ওজন নেয়ার পালা৷ এই প্রক্রিয়াটা দিনে ৩০ বার পর্যন্তও চলে৷
খাওয়াকে ঘিরেই চিন্তাভাবনা ঘুরতে থাকে হানার৷ সদা সর্বদা ব্যাপারটাকে গোপন রাখতে সচেষ্ট থাকতে হয় তাঁকে৷ অচিরেই পারিপার্শ্বিক জগতের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এই নারী৷ একাকীত্বই হয় সঙ্গী৷
রোগটি ব্যয়বহুলও
এই রোগটির জন্য খরচও কম হয় না৷ খাবার শরীর থেকে বের করে ফেলার জন্য অনেক রকম উপকরণ কিনতে হয়৷ সহকর্মীরা তাঁকে ভদ্র ও আত্মবিশ্বাসী এক নারী বলেই মনে করেন৷ কিন্তু আসলে নিজেকে অতি ক্ষুদ্র ও অসহায় মনে হয় তাঁর৷ এই অবস্থা কতদিন চলতে থাকতো, তা বলা যায় না৷ কিন্তু প্রচণ্ড এক আঘাত সজাগ করে দেয় তাঁকে৷ একবার বমি করার পর সারা শরীর কাঁপতে থাকে হানার৷ কেননা মস্তিষ্কে শর্করার ঘাটতি হয়েছিল৷ চিন্তাশক্তিও লোপ পেয়েছিল৷ এই ঘটনার পর ডাক্তারকে খুলে বলেন সমস্যাটা৷ তিনি তাঁকে বুলিমিয়ার এক থেরাপি কেন্দ্রের টেলিফোন নাম্বার লিখে দেন৷ হানার সামনে মুক্তির দুয়ার খুলে যায়৷
দৈহিক গঠনে অসন্তুষ্টি
বুলিমিয়ার রোগীরা নিজেদের দৈহিক গঠন নিয়ে সন্তুষ্ট নয়৷ অনেকে দেখতে কঙ্কালসার হলেও নিজেকে স্থূল মনে করে৷ শরীরকে সব সময় চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য না দিতে দিতে ক্ষুধা তৃষ্ণার অনুভূতিটাই যেন চলে যায় তাদের৷ এছাড়া রাগ, দুঃখ, আনন্দ, ক্লান্তি এই সব অনুভূতিও একাকার হয়ে যায়৷
বুলিমিয়া হলে ওষুধ দিয়ে চিকিত্সা করা সম্ভব৷ না খেয়ে থাকলে বা খেয়ে বমি করে ফেললে শরীরে সেরোটিনিন নামে একধরনের হরমোনের ঘাটতি হয়৷ এই হরমোন সুখানুভূতি সৃষ্টি করে৷ মানবদেহ নিজেই সেরোটিনিন প্রস্তুত করতে পারে৷ আর এজন্য প্রয়োজন ট্রাইপটোফান নামে এক ধরনের অ্যামোইনো অ্যাসিড৷ এই অ্যাসিড শুধুমাত্র খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে গ্রহণ করা যায়৷ সাধারণত প্রচণ্ড ক্লান্তি, ভীতি ও মাইগ্রেন হলে সেরোটিনিন দিয়ে চিকিত্সা করা হয়৷ যারা খাওয়াটা শরীরে রাখতে চায় না বা খুব কম খায়, তাদের যে সেরোটিনিনের অভাব হবে তা বলাই বাহুল্য৷ তাই বুলিমিয়া ও অ্যানোরেক্সিয়ার রোগীদের চিকিত্সাতেও সেরোটিনিন ব্যবহার করা হয়৷ এক্ষেত্রে ডিপ্রেশনের ওষুধও কাজে লাগে৷ তবে কোনো কিছুই সাইকো থেরাপির বিকল্প হতে পারেনা৷
নিজের শরীরকে ভালবাসতে শেখা
বনের ইউনিভার্সিটি ক্লিনিকের সাইকো সোমাটিক বিভাগের প্রধান চিকিৎসক কাট্রিন ইমবিয়েরোভিচ জানান, ‘‘ভুক্তভোগীদের প্রথমে শেখানো হয় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শরীরকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে – প্রয়োজন হলে ভালবাসার দৃষ্টিতে দেখতে৷ সংলাপের মাধ্যমে তারা জানতে পারেন কোন কোন চাহিদা তারা দমিয়ে রাখেন৷ আসলে কী খেতে তাদের ইচ্ছা হয়৷ কোন কোন খাবার তারা জোর করে নিষিদ্ধের তালিকায় রেখেছেন৷ এসব স্পষ্ট হয় তাদের কাছে৷''
ব্যক্তিগত বা সামাজিক কোনো সমস্যা হলে অনেকে খাবার বিসর্জন দিয়ে তা ভুলে থাকতে চান৷ সাইকো থেরাপিতে সংকটের মোকাবিলা করতে অনুপ্রাণিত করা হয়৷ খাবারের ওপর ঝাল ঝেড়ে যে সমস্যার সমাধান করা যায় না, তা বোঝানো হয় ভুক্তভোগীদের৷
স্বাস্থ্যের প্রচণ্ড ক্ষতি হয়
আহারে অনীহা মানসিক রোগ হলেও শরীরের ওপর তার মারাত্মক প্রভাব পড়ে৷ হাড়ের ক্ষতি, দন্তরোগ, চুল পড়া, ত্বকের শুষ্কতা এমনকি কিডনি ও হার্টের সমস্যাও হতে পারে এ থেকে৷ অভুক্ত থাকতে থাকতে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি অনেক সময় কর্মক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে৷ পরিণামে মৃত্যুই অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়৷ যে ঘটনা খুব বিরল নয়৷ ভুক্তভোগীদের অনেকে ডিপ্রেশনের শিকার হন৷ বেছে নেন আত্মহত্যার পথ৷
প্রয়োজনীয় থেরাপি পেলে এবং খাবারকে আবার উপভোগ করতে শিখলে এই মানসিক রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়াও সম্ভব৷ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে আরোগ্যের হার ৩০ শতাংশ৷