ইউক্রেন-রাশিয়া নিয়ে কোন পথে বাংলাদেশ
৫ মার্চ ২০২২কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ভোট দানে বিরত থেকে তার স্বাধীন কূটনৈতিক অবস্থান প্রকাশ করেছে৷ আর এই ইস্যুতে জাতিসংঘে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান এক৷ এটা একটা বিরল ঘটনা৷ তাই বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় এর বড় কোনো রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম৷
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শনিবার বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থি৷”
বাংলাদেশের এই অবস্থানের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি এই আক্রমণকে ইউক্রেনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ এবং তার স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করে৷ এ ধরনের আধিপত্যবাদী ও সস্প্রসারণবাদী তৎপরতা জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী অপরাধ৷ এই আক্রমণ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর হুমকি৷”
তার মতে, ‘‘বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার তার ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে দেশবাসীর জনমতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ইউক্রেন ইস্যুতে জাতিসংঘের প্রস্তাবের পক্ষে ভোটদানে বিরত থেকেছে, যা বাংলাদেশের সংবিধান ঘোষিত গণতন্ত্র ও মানবিক মূল্যবোধের নীতিমালা পরিপন্থি৷”
মির্জা ফখরুলের বক্তব্যকে সমর্থন করে রবিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং বিদেশ বিষয়ক কমিটির প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকারের এই অবস্থান বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে৷ ভূ-রাজনৈতিকভাবে আমরা লাভবান হবো বলে মনে হয়না৷ সবচেয়ে বড় কথা আমাদের স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতাকামী, মুক্তিকামী৷ তার বিরুদ্ধে সরকার অবস্থান নিয়েছে৷ দেশের মানুষ এটা মেনে নেবে না৷”
এর জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘‘বিএনপি নেতারা মূর্খের মত কথাবার্তা বলছে৷ এটা তাদের অজ্ঞতার পরিচয়৷ জাতিসংঘের যেকোনো সদস্যের ভোট দেয়ার যেমন অধিকার আছে৷ ভোট না দেয়ারও অধিকার আছে৷ ভোট না দিলে জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন হবে এটা তাদের কে বলেছে? এটা হলো তাদের অজ্ঞতা৷”
তার মতে, ‘‘বিএনপির এখন কোনো কাজ নেই, কোনো ইস্যু নেই৷ তাই বসে বসে এইসব কথা বলে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, পশ্চিমা দেশকে উসকে দেয়ার চেষ্টা করছে৷ তাদের এসব কথাই প্রমাণ করে তারা দেশবিরোধী ৷তারা চায় যেকোনো অপ্রাসঙ্গিক একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রকে বিতর্কের মধ্যে ফেলা৷ এতে তো রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ তারা একটা দেশপ্রেমহীন যে দেশকে ধ্বংস করে হলেও দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করতে চায়৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘তারা এটা নিয়েও রাজনীতি করার চেষ্টা করছে৷”
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই ইস্যুতে ভারত চাপের মুখে পড়তে পারে৷ পাকিস্তান লাভবান হচ্ছে৷ আর বাংলাদেশে তেমন কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব পড়বেনা৷ দক্ষিণ এশিয়ায়ার বৃহৎ শক্তির অবস্থান বাংলাদেশকে সুবিধা দেবে৷ আর যেহেতু ইউক্রেন- রাশিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতি এখনো শেষ হয়ে যায়নি ফলে এখনই এইসব দেশের চ‚ড়ান্ত হিসাব নিকাশ করার সময় আসেনি৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শান্তনূ মজুমদার মনে করেন, ‘‘বাংলাদেশ ভোট দানে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে তার অবস্থান জানান দিয়েছে৷ এখন আর আগের মত অবস্থা নেই যে চাপ দিয়ে কোনো একটা অবস্থানে যেতে বাধ্য করা যায়৷ বাংলাদেশ সেই অবস্থাটা পার হয়ে এসেছে৷ ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এই ইস্যুতে একই জায়গায় আছে৷ দক্ষিণ এশিয়ার প্রভাবশালী দেশগুলোর একই অবস্থানের কারণে এই ইস্যুতে তেমন প্রভাব পড়বে বলে আমার মনে হয় না৷”
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর কোনো প্রভাব পড়বে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘শুধু ইউক্রেন কেন যেকোনো দেশে হামলা, আগ্রাসন নিন্দনীয়৷ বাংলাদেশের সংবিধান বিরোধী৷ কিন্তু কূটনৈতিক সিদ্ধান্তে অনেক বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়৷ এর সঙ্গে দেশের ভিতরের রাজনীতি সব সময় মেলে না৷ তাহলে ইয়েমেনে দিনের পর দিন সৌদি বিমান সে ব্যাপারে কী বলবেন? সেখানে তো কেউ নিন্দা জানাচ্ছে না৷ সরকার না, বিরোধী রাজনৈতিক দলও না৷ তাই কূটনৈতিক সিদ্ধান্তকে কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবেই দেখা ভালো৷”
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল(অব.) মো. শহীদুল হক মনে করেন, ‘‘ইউক্রেন ও রাশিয়া ইস্যুতে আন্তর্জাতিক কূটনীতি এখনো শেষ হয়ে যায়নি৷ সেটা শেষ হলে যুদ্ধ বিরতি হতো না৷ কূটনীতি এখনো সচল আছে৷ তাই এখনো খুব বড় আতঙ্কের কারণ নেই৷”
তার কথা, ‘‘ইউক্রেন ও রাশিয়া দুইটি দেশই বাংলাদেশের ভালো বন্ধু৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়ার অনেক বড় অবদানের আবেগ আমাদের আছে৷ আর রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়াও তাদের সাথে আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য ও উন্নয়নমূলক প্রকল্প আছে৷ ইউক্রেন থেকে আমরা গম আনি, আর্মস আনি৷ ফলে আমাদের কাছে অপশন কী ছিলো সেটাই প্রশ্ন৷ বিরত থাকা ছাড়া কোনো অপশন ছিলো?”
তিনি বলেন, ‘‘ভারতে অবশ্য এই ভোট দানে বিরত থাকা একটা বড় পলিটিক্যাল ইস্যুতে পরিণত হয়েছে৷ অ্যামেরিকা কিন্তু ভারতের কাছ থেকে বড় একটা সাপোর্ট চেয়েছিলো, পায়নি৷ আর পাকিস্তানকে তো আগেই তালাক দিয়েছে৷ র্যাব ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ একটু ব্যাকফুটে আছে৷ তবে মনে হয়না নতুন করে এই ইস্যুতে কোনো চাপ আসবে৷”
তিনি মনে করেন, ‘‘এই ইস্যুতে ভারত কিছুটা চাপে পড়বে৷ তবে পাকিস্তান লাভবান৷ কারণ সে অনেক কম দামে বাণিজ্যিক চুক্তি করেছে রাশিয়ার সাথে৷ বাংলাদেশে এমনিতে ব্যবসা বাণিজ্যে প্রভাব পড়বে বলে মনে হয়৷”
তবে এই বিশ্লেষকদের কথা, যুদ্ধ কতটা দীর্ঘায়িত হয় তার ওপর পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে৷ সেজন্য সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে৷